কথায় আছে, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। এমন প্রবাদই প্রযোজ্য শিক্ষা প্রশাসনের জন্য। আইন অমান্যকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে যত গর্জন ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, বাস্তবে সেরূপ বর্ষণ হয়নি। যারা নিয়ম ভঙ্গ করছে, তারা বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছে। অনুমোদন বাতিল, নতুন ভর্তি বন্ধের হুঙ্কার ছুড়ছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। একের পর এক সময় বেঁধে দেওয়া আলটিমেটাম দিয়েও বাগে আনতে পারছে না সরকার।
জানা গেছে, নিয়ম ভঙ্গকারী ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী সেশনে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দফায় দফায় আলটিমেটামের পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেনি এসব বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে নতুন করে বিভাগ ও বিষয় খোলা এবং সমাবর্তন পালনের অনুমতি পাবে না এসব বিশ্ববিদ্যালয়। একই সঙ্গে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে আসা আর্থিক অনুদান বাতিলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ থাকবে। গত রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বছরের পর বছর এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার রেকর্ড আছে ।
এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন উপেক্ষা করে মন্ত্রণালয় মৌখিকভাবে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সময় দেয়, দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালে, তৃতীয় দফায় ২০১৩ সালে, চতুর্থ দফায় ২০১৫ সালের জুনে। সর্বশেষ গত বছর ২৪ জানুয়ারির মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনার আলটিমেটাম দেয়। কার্যত কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।
ইউজিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাত বছরের মধ্যে যারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ, তাদের পাঠদানের স্বীকৃতি বাতিলসহ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এক একর এবং অন্য এলাকায় দুই একর নিজস্ব জমি থাকতে হবে। কিন্তু অনেকে তা মানছেন না। সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার নেই ইউজিসির। তারা মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়ন করে এবং সুপারিশ প্রেরণের ক্ষমতা রাখে। ইউজিসির অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নেওয়ার ধরন হচ্ছে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ প্রবাদের মতোই।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সভায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণী মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ইউজিসির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, পুরনো ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৯টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। বাকি ৩২টির মধ্যে ১২টি ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ওইসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে, কেন তারা (কর্তৃপক্ষ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও আইনের বিধান প্রতিপালন করেনি।
ইউজিসির সুপারিশ অনুযায়ী ভর্তি বাতিলের তালিকায় আছে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র জানায়, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্যকারী অন্তত ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাব চাইবে সরকার। পরবর্তী ধাপে শাস্তির ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আব্দুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত কমিটি কাজ করছে। তারা একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত বছরের ৭ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে গত জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। পরে আরও কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক আখতার হোসেনকে। অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য এম শাহ নেওয়াজ আলী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) আব্দুলাহ আল হাসান চৌধুরী। সদস্য সচিব করা হয় ইউজিসির উপপরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) জেসমিন পারভীনকে। কমিটি চার দফায় সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয় মন্ত্রণালয়ে। এর পর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়ে ফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র সাতটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছে। কোনোটি জমি কিনেছে, কোনোটি আংশিক কার্যক্রম শুরু করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মার্কেটের ওপর ভাড়াবাড়িতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েকটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার দাবি করলেও বেশিরভাগ কার্যক্রম তাদের চলছে ভাড়া করা বাড়িতে।
অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাত বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে পাঠদানের স্বীকৃতি বাতিলসহ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এক একর এবং এর বাইরে দুই একর নিজস্ব জমি থাকতে হবে।
দেশে বর্তমানে ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন লাখ ৪২ হাজার ৮৪ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। আহ্ছানউল্লা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ রয়েছে। শর্তসাপেক্ষে সিটি ইউনিভার্সিটিও স্থায়ী সনদ নিয়েছে। বাকিগুলো অস্থায়ী সনদ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ইতোমধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে সব শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি ইউএসটিসি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, দি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, সিটি ইউনিভার্সিটি।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২টি। এগুলো হলো ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সময়