আল মুস্তাসিম নবী নিকু : দলিল নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন হলো সম্পত্তি সংক্রান্ত অধিকারের বৈধ স্বীকৃতি প্রদানকারী একটি আবশ্যিক আইনি প্রক্রিয়া। রেজিস্ট্রেশন না হলে দলিলের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ে, ফলে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় The Registration Act, 1908 এর মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, Sub-Registrar বা Registrar দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান, যা আইনি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে দলিল দাতার করণীয় কী, এবং আদালতের কী ভূমিকা রয়েছে—তা ব্যাখ্যার জন্য ৭১ থেকে ৭৭ নং ধারাগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
১। Sub-Registrar কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন অস্বীকৃতি – Section 71
Section 71 অনুযায়ী, যদি Sub-Registrar কোনো দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তিনি—
• অস্বীকারের কারণ Book No. 2 এ লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করবেন;
• দলিল উপস্থাপনকারীকেও লিখিতভাবে অস্বীকৃতির কারণসহ একটি আদেশ প্রদান করবেন।
এই ধারা রেজিস্ট্রার কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখে এবং স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে।
উদাহরণ:
‘ক’ একজন ব্যক্তি জমির দলিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেন, কিন্তু Sub-Registrar দলিলের মধ্যে পরিপূর্ণ খতিয়ানের তথ্য না থাকায় রেজিস্ট্রেশন অস্বীকার করেন। Section 71 অনুযায়ী, তিনি লিখিত আদেশে অস্বীকৃতির কারণ জানাতে বাধ্য।
২। আপিল প্রক্রিয়া – Section 72
Sub-Registrar এর সিদ্ধান্তে যদি দলিল দাতার আপত্তি থাকে, তাহলে তিনি Section 72 অনুযায়ী Registrar এর কাছে আবেদন করতে পারেন। Registrar পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে—
• দলিল রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশ দিতে পারেন, অথবা
• Sub-Registrar-এর অস্বীকৃতি বহাল রাখতে পারেন।
এই ধারা একটি প্রশাসনিক প্রতিকার ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করে, যা আপিলকারীর ন্যায় নিশ্চিত করে।
উদাহরণ:
উপরোক্ত ‘ক’ ব্যক্তিটি খতিয়ান পত্র জমা দেওয়ার সত্ত্বেও রেজিস্ট্রেশন অস্বীকৃত হওয়ায় Registrar এর কাছে আবেদন করেন। পর্যালোচনায় দেখা যায় Sub-Registrar তথ্য যাচাই না করেই অস্বীকৃতি দিয়েছিলেন, ফলে Registrar দলিল রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশ দেন।
৩। Registrar কর্তৃক চূড়ান্ত অস্বীকৃতি – Section 76
Registrar যদি আবেদন খারিজ করে দেন, অথবা রেজিস্ট্রেশনের আদেশ না দেন, তাহলে তা চূড়ান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পরিস্থিতিতে দলিল দাতার সামনে একমাত্র পথ হলো আদালতের শরণাপন্ন হওয়া।
৪। আদালতের প্রতিকার – Section 77
Section 77 অনুযায়ী, যদি Registrar দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান, তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি:
• ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে স্থানীয় সিভিল কোর্টে একটি মামলা দায়ের করতে পারেন;
• যেখানে আদালত বিচারিক পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ডিক্রি প্রদান করতে পারেন;
• এবং যদি প্রমাণ হয় যে দলিল বৈধ ও রেজিস্ট্রেশনযোগ্য, তাহলে আদালত Registrar-কে রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশ দিতে পারেন।
উদাহরণ:
Registrar কোনো ভিত্তিহীন কারণে ‘ক’ এর দলিল রেজিস্ট্রেশনে অস্বীকৃতি জানান। দলিলদাতা আদালতে মামলা করেন। শুনানিতে প্রমাণিত হয় যে দলিলটি আইনানুগ, তাই আদালত একটি নির্দেশ জারি করেন—দলিলটি ১৫ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রি করতে হবে।
৫। ব্যবহারিক সমস্যা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশে দলিল রেজিস্ট্রেশন একটি জটিল ও ব্যুরোক্রেটিক প্রক্রিয়া। অনেক সময় Sub-Registrar বা Registrar—
• রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন হয়ে,
• ঘুষ বা ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রভাবিত হয়ে,
• অথবা প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে—
সঠিক দলিলও রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান। অনেক ক্ষেত্রে এই অস্বীকৃতি লিখিতভাবে দেওয়া হয় না, যা Section 71 এর সরাসরি লঙ্ঘন। জনগণের বড় একটি অংশ আইন সম্পর্কে অসচেতন হওয়ায় Section 72 বা Section 77 অনুযায়ী যথাযথ প্রতিকার গ্রহণে ব্যর্থ হন।
এতে শুধু ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার ক্ষুণ্ন হয় না, বরং সামগ্রিক আইনের শাসনের নীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৬। সুপারিশ
১। রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে—Section 71 অনুযায়ী প্রত্যেক অস্বীকৃতির আদেশ লিখিত ও নথিভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২। জনগণের আইনি সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা Section 72 ও Section 77 এর প্রতিকার ব্যবস্থাকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
৩। প্রশিক্ষণ ও নজরদারি বাড়াতে হবে Sub-Registrar ও Registrar দপ্তরে, যাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নাগরিক সেবার মান উন্নত হয়।
৪। জরুরি ভিত্তিতে সময়সীমা নির্ধারণ করে দ্রুত প্রতিকার নিশ্চিত করা উচিত, বিশেষত আদালতের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশ প্রদানে।
পরিশেষে বলা যায় যে, The Registration Act, 1908-এর Section 71 থেকে 77 পর্যন্ত ধারাসমূহ দলিল রেজিস্ট্রেশনে একটি সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক ও বিচারিক প্রতিকার কাঠামো গড়ে তুলেছে। কিন্তু এই কাঠামোর সফলতা নির্ভর করে এর বাস্তব প্রয়োগ ও আইনি সচেতনতার উপর। রেজিস্ট্রিকর্তৃপক্ষের পেশাগত নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা এবং আদালতের কার্যকর ভূমিকা একত্রে কাজ করলে কেবল নাগরিকের সম্পত্তি অধিকার নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে। অন্যথায়, আইনটি শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, আর ন্যায়বিচার হবে বিলম্বিত এবং ব্যয়সাপেক্ষ।
লেখক : আল মুস্তাসিম নবী নিকু; অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট। ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com