মতিউর রহমান
মতিউর রহমান

ফৌজদারি কার্যবিধির ২০২৫ সালের নতুন সংশোধনীতে যা আছে

মতিউর রহমান : ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর দুটি সংশোধন আনয়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করেছেন। এই সংশোধনীর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ ব্যাপক উপকৃত হবে। আসুন জেনে নিই কি কি পরিবর্তন এসেছে।

জরিমানা প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি

ধারা ৩২ সংশোধন করে ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা প্রদানের ক্ষমতা ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ, ২য় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটদের ৫ হাজার হতে ৩ লাখ ও ৩য় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটদের ২ হাজার হতে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে।

গ্রেফতারে বিশেষ সুরক্ষা

গ্রেফতারের সময় বিষয়ে আসামীকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ধারা ৪৬ক থেকে ৪৬ঙ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিধানের সংশোধন আনয়ন করা হয়েছে।

(ধারা ৪৬ ক) মূলত গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ বা অন্য যিনি গ্রেপ্তার করবেন, তাদের কী কী নিয়ম মানতে হবে তা বলা হয়েছে।

পরিচয় জানাতে হবে – গ্রেফতারী টিমকে, তা জানাতে হবে এবং চাইলে নিজের পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। গ্রেপ্তারকারীকে নিজের নাম স্পষ্টভাবে ধারণকরণ করতে হবে। যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাকে ও আশেপাশে উপস্থিত ব্যক্তিদের এই পরিচয় জানাতে হবে।

গ্রেপ্তারের লিখিত কাগজ (মেমোরেন্ডাম) তৈরি করতে হবে –

    • এতে অন্তত একজন সাক্ষীর স্বাক্ষর থাকতে হবে, যিনি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা স্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তি।

    • যদি এমন কেউ না পাওয়া যায়, কারণ লিখতে হবে।

    • গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিই চাইলে তার হাত বা আঙুলের ছাপ দিতে পারে। তবে তিনি এটি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।

পরিবার বা বন্ধুকে খবর দিতে হবে – যদি বাসার বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা মনোনীত বন্ধুকে সময়, স্থান ও কোথায় রাখা হবে তা জানাতে হবে।

শারীরিক আঘাত থাকলে চিকিৎসা দিতে হবে – যদি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে, তাহলে ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে, ডাক্তারি সনদ নিতে হবে এবং আঘাতের কারণ লিখতে হবে।

আইনজীবী বা আত্মীয়ের সাথে দেখার সুযোগ দিতে হবে – গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি চাইলে নিজের পছন্দের আইনজীবী বা নিকট আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে পারবে, সম্ভব হলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে।

(ধারা ৪৬খ) গ্রেপ্তারের পর তথ্য লিপিবদ্ধ করা ও পরিবারের কাছে তথ্য দেওয়ার নিয়ম উল্লেখ করেছে।

গ্রেপ্তারের রেকর্ড অফিসিয়াল রেজিস্টার রাখতে হবে –

  • কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার কারণ লিখতে হবে।

  • কে অভিযোগ দিয়েছে বা তথ্য দিয়েছে তার নাম ও তথ্য লিখতে হবে।

  • যার কাছে গ্রেপ্তারের খবর দেওয়া হয়েছে (পরিবার সদস্য বা বন্ধু) তার নাম ও তথ্য লিখতে হবে।

  • গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির হেফাজতে যারা আছেন তাদের নাম ও তথ্যও লিখতে হবে।

জেনারেল ডায়েরিতে এন্ট্রি রাখতে হবে –

  • যেই থানার এলাকায় গ্রেপ্তার হয়েছে, সেই থানার জেনারেল ডায়েরিতে সঙ্গেসঙ্গেই নথিভুক্ত করতে হবে।

  • যদি গ্রেপ্তারকারী ঐ থানার না হন, তাহলে গ্রেপ্তারের মেমোরেন্ডামের কপি ঐ থানার অফিসার-ইন-চার্জকে দিতে হবে, যাতে তিনি ডায়েরিতে এন্ট্রি করেন।

পরিবার বা পরিচিতদের তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা –

  • এই রেজিস্টার বা ডায়েরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চাইলে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আত্মীয়, বন্ধু বা প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত তথ্য দিতে বাধ্য থাকবেন।

(ধারা ৪৬গ) – গ্রেপ্তারের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শন

  • প্রতিটি জেলা ও মহানগর এলাকায় পুলিশ সুপার বা পুলিশ কমিশনার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে (কমপক্ষে সহকারী উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার) দায়িত্ব দেবেন।

  • তাঁর কাজ হবে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের নাম, ঠিকানা ও কোন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে তা নথিভুক্ত রাখা।

  • এই তথ্য প্রতিটি থানায় ও জেলা/মহানগর সদর দফতরে দৃশ্যমানভাবে (সর্বোত্তম হলে ডিজিটালভাবে) প্রদর্শন করতে হবে।

(ধারা ৪৬ঘ) – গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা

  • যিনি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে হেফাজতে রাখবেন, তাঁর দায়িত্ব হবে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার যুক্তিসঙ্গত যত্ন নেওয়া।

(ধারা ৪৬ঙ) – গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা

গ্রেপ্তারের পর অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে –

    • সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে।

    • সরকারি চিকিৎসক না থাকলে নিবন্ধিত চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা দিতে হবে।

    • মহিলাহলে, সম্ভব হলে মহিলা ডাক্তার বা মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতিতে পরীক্ষা করতে হবে।

সার্টিফিকেট ও রিপোর্ট –

    • চিকিৎসক বা নিবন্ধিত চিকিৎসক পরীক্ষার সার্টিফিকেট ও রিপোর্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে দেবেন।

ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে চিকিৎসা –

    • অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করাতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নির্দেশ দিতে পারবেন।

    • গুরুতর অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে, হাসপাতাল ভর্তি প্রয়োজন হলে ও সরাসরি হাজির করানো সম্ভব না হলে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে হাজির করানো যেতে পারে, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিতে।

(ধারা ৫১) – গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া মূল্যবান সামগ্রীর তালিকা

  • গ্রেপ্তারের সময় অনেক সময় ব্যক্তির কাছে টাকা, অলঙ্কার, মোবাইল ইত্যাদি মূল্যবান বস্তু থাকতে পারে।

  • যদি এসব বস্তু অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয় অর্থাৎ অপরাধের আলামত হয়, তাহলে মামলার জব্দতালিকায় (seizure list) উল্লেখ করতে হবে।

  • কিন্তু যদি অপরাধের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে, তবে এগুলো তছরুপের বা নয়ছয়ের অভিযোগ এড়াতে –

    1. এসব মূল্যবান সামগ্রীর জন্য পৃথক একটি তালিকা তৈরি করতে হবে।

    2. সম্ভব হলে তালিকায় একজন সাক্ষীর স্বাক্ষর নিতে হবে।

    3. তালিকার একটি কপি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা নিকটজনকে দিতে হবে।

(ধারা ৫৪) – বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার সম্পর্কিত বিধান (সংশোধিত)

  • অনেকের ধারণা, ৫৪ ধারায় মানে অভিযোগ ছাড়াই ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার; কিন্তু আসলে এই ধারায় পুলিশ যেসব ক্ষেত্রে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে, তার বিস্তারিত তালিকা আছে।

  • থানায় দায়ের করা এজাহার বা আদালতে দায়ের করা নালিশ মামলার তদন্ত যদি পুলিশ করে এবং আমলযোগ্য (কগনিজেবল) অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তবেই মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার ক্ষমতা ৫৪ ধারার মধ্যেই পড়ে।

সংশোধনীতে যা পরিবর্তন হয়েছে –

অপরাধের ঘটনার শর্ত –

    • আমলযোগ্য অপরাধে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে দেখাতে হবে যে ওই ব্যক্তি পুলিশের সামনে অপরাধ করেছেন।

    • যদি অপরাধ সম্পর্কিত এজাহার বা নালিশ মামলা তদন্তাধীন থাকে, তবেও পুলিশকে দেখাতে হবে যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের কারণ আছে।

সাত বছর বা তার কম সাজাযোগ্য অভিযোগ হলে অতিরিক্ত শর্ত –

    • পুলিশকে দেখাতে হবে গ্রেপ্তার জরুরি, যাতে:
       আসামী আরও অপরাধ না করতে পারে,
       পালিয়ে যেতে না পারে,
       বা সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে না পারে।

গ্রেপ্তার করা বা গ্রেপ্তার না করার কারণ ব্যাখ্যার বাধ্যবাধকতা –

    • আমলযোগ্য অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা বা গ্রেপ্তার না করার দুই ক্ষেত্রেই পুলিশকে কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। অর্থাৎ, এই সুযোগে পুলিশ চাইলে গ্রেফতার অবশ্যক এমন আসামীকে গ্রেফতার না করেও এড়িয়ে যেতে পারে না।

নিবারণমূলক আটক নিষিদ্ধ –

    • শুধু প্রতিরোধমূলক (preventive) আটক করার জন্য ৫৪ ধারা ব্যবহার করা যাবে না।

(ধারা ৫৪ক)- অনুসারে গ্রেফতারের পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে বাধ্য।

(ধারা ৬৭ক) – গ্রেপ্তার সংক্রান্ত নিয়ম না মানলে করণীয়

  • গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে যখন ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের সামনে হাজির করানো হবে, তখন যাচাই করবেন যে গ্রেপ্তারের নিয়মগুলো ঠিকভাবে মানা হয়েছে কি না।

  • যদি দেখা যায়, গ্রেপ্তারের কোন নিয়ম অবহেলাজনিতভাবে ভঙ্গ হয়েছে বা মানা হয়নি,

  • তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত লিখিতভাবে কারণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য সার্ভিস রুল অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।

সমন জারির বিশেষ বিধান

(ধারা ৬৯) অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থাৎ ফোন কল, ম্যাসেজের মাধ্যমে সমন জারির বিধান করা হয়েছে। ধারা ৭০ সংশোধনের মাধ্যমে এখন হতে পরিবারের পুরুষ বা মহিলা যে কারও কাছে সমন জারির বিধান করা হয়েছে।

পুলিশ তদন্ত ও রিমান্ড

(ধারা ১৬৭) – পুলিশ তদন্ত চলাকালে হেফাজতের বিধান

ম্যাজিস্ট্রেটের হেফাজতের অনুমতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী;

  • গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে আদালত না আনলে, ম্যাজিস্ট্রেট মোট ১৫ দিনের বেশি নয় এমন মেয়াদের জন্য হেফাজতের অনুমতি দিতে পারেন।

  • হেফাজত হতে পারবে পুলিশ হেফাজত বা বিচারিক হেফাজত (জেল বা পুলিশের বাইরে অন্য কোনো স্থানে)।

  • কোনো মামলায় মোট ১৫ দিনের বেশি পুলিশ হেফাজত দেওয়া যাবেনা—তার বেশি হলে কেবল বিচারিক হেফাজত দেওয়া যাবে।

পুলিশ হেফাজতের আগে ও পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা (উপ-ধারা ২ক)

  • পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার আগে ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে অভিযুক্তকে নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করাতে পারেন।

  • পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ শেষ হলে দ্রুত অভিযুক্তকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে।

  • হাজিরের সময় শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে অভিযুক্ত নির্যাতনের অভিযোগ করলে ম্যাজিস্ট্রেট নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতাল মেডিকেল পরীক্ষা করাবেন।

  • মেডিকেল রিপোর্টে নির্যাতনের প্রমাণ মিললে ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

(ধারা ১৬৭ক) – শো-অ্যারেস্ট ও হেফাজত বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের করণীয়

শো-অ্যারেস্টের ক্ষেত্রে শর্ত –

  • কোনো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি চান অন্য মামলায় আগে থেকেই হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে সেই মামলায় “শো-অ্যারেস্ট” দেখানো হোক,

    • ম্যাজিস্ট্রেট তা অনুমোদন করবেন শুধুমাত্র যদি:

      1. ওই ব্যক্তিকে তার সামনে হাজির করা হয়,

      2. মামলার দায়েরির কপি দেওয়া হয়,

      3. ব্যক্তিকে নিজের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়,

      4. এবং আবেদনটি যথাযথভাবে ভিত্তিসম্পন্ন মনে হয়।

প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের জন্য গ্রেপ্তার হলে –

  • যদি পুলিশ কর্তৃক ফরওয়ার্ডিং রিপোর্ট হতে প্রতীয়মান হয় যে গ্রেপ্তার কেবল প্রতিরোধমূলক আটক (preventive detention) আইনের অধীনে করা হয়েছে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই ব্যক্তিকে বিচারিক হেফাজতে পাঠাতে পারবেন না।

অবৈধভাবে আটক করায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা –

  • যদি ম্যাজিস্ট্রেটের বিশ্বাস হয় যে কোনো কর্মকর্তা আইনিভাবে কাউকে আটক করার জন্য ওই আবেদন করেছেন, তবে তিনি দণ্ডবিধির ২২০ ধারায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

(ধারা ১৭৩ক) – এর সারমর্ম হলো—

  • তদন্ত চলাকালীন (ধারা ১৭৩(১)-এর চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার আগেই) পুলিশ কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার বা মানের কর্মকর্তার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দিতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারবেন।

  • ওই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে যদি দেখা যায় যে কোনো আসামির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে, তবে ওই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবেন এবং আদালত যথাযথভাবে সন্তুষ্ট হলেও ওই আসামিকে অস্থায়ীভাবে অব্যাহতিতে রাখতে পারবেন; বাকী আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে।

  • পরবর্তীতে তদন্ত শেষে যদি নতুন ও পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে পূর্বে অব্যাহতিপ্রাপ্ত আসামিকেও চূড়ান্ত পুলিশ রিপোর্টে অভিযুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

(ধারা ১৭৩খ) এর মূল বক্তব্য;

তদন্ত শেষের সময়সীমা

  • অপরাধের তথ্য পাওয়ার দিন থেকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে।

সময় বাড়ানোর নিয়ম

  • যৌক্তিক কারণে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা না গেলে—

    • তদন্ত কর্মকর্তা দায়েরিত কারণ লিখবেন।

    • ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদন করবেন (কারণ ও কত সময় লাগবে তা উল্লেখ করে)।

    • এর কপি তদন্ত তদারককারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠাবেন।

ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা

  • আবেদন দেখে ম্যাজিস্ট্রেট যুক্তিসঙ্গত সময় বাড়াতে পারেন।

  • বাড়ানো সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে।

বাড়ানো সময়েও শেষ না হলে

  • তদন্তকারী কর্মকর্তা লিখিতভাবে বিলম্বের কারণ ম্যাজিস্ট্রেট ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবেন।

বিলম্বের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

  • ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে—

    • অন্য কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করাতে পারেন, অর্থাৎ তদন্তকারী পরিবর্তন করতে পারেন।

    • বিলম্বকে অযোগ্যতা বা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে তদন্তকারীর গোপন নথি লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলতে পারেন।

অভিযুক্তকে সাক্ষী করা

  • তদন্ত প্রতিবেদন জমাদানের পর আদালত মনে করলে কোনো অভিযুক্তকে বিচারিক স্বার্থে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করতে পারেন।

তদন্তে গাফিলতির শাস্তি

  • বিচার শেষে আদালত দেখল যে তদন্ত কর্মকর্তা—

    • প্রমাণ সংগ্রহে গাফিলতি করেছেন,

    • যার আসামি হওয়া উচিত তাকে সাক্ষী করেছেন, অথবা

    • গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জিজ্ঞাসাবাদ না করার কারণ উল্লেখ ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়েছেন,

    • তাহলে আদালত এটিকে অসদাচরণ বা অযোগ্যতা ধরে শাস্তির জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিতে পারবেন।

সি আর মামলা খারিজ

(ধারা ২৪৭) এর সংশোধনের মাধ্যমে এখন থেকে নালিশী দরখাস্তের মাধ্যমে দায়েরকৃত সকল CR মামলাই বাদির অনুপস্থিতির কারণে খারিজ হবে। পূর্বে শুধু সমন দেওয়া হয়েছে এমন CR মামলা খারিজ করা যেত।

মিথ্যা মামলার শাস্তি বাধ্যতামূলক

(ধারা ২৫০) এর সংশোধনের মাধ্যমে মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলা রোধে আবশ্যিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হয়েছে। পূর্বে এই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিচারকের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা ছিল। এই জরিমানামূলক শাস্তির পরিমাণ ক্ষেত্রমতো ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার, ৫০০ থেকে বৃদ্ধি করে ২৫ হাজার, ১০০ থেকে বৃদ্ধি করে ৫ হাজার ও ৩ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে।

যেকোন স্থানে স্যামারি ট্রায়াল

(ধারা ২৬০) এর সংশোধনী ও ধারা ২৬৪ক এর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে স্যামারি ট্রায়ালের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের আর্থিক এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে। পূর্বে চুরি, আত্মসাৎ প্রভৃতির মামলার বিষয়বস্তু মূল্যের অনূর্ধ্ব দশ হাজার টাকা হলে তার বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে এই মূল্যমান বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত বিচার সম্ভব হলে একই বৈঠকে আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে এবং যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা করা যাবে। এর মাধ্যমে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্টের বিকল্প হিসেবে একই রূপে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ স্যামারি ট্রায়াল কোর্টে বিচার করতে পারবেন।

অনুপস্থিতিতে বিচার সহজীকরণ

(ধারা ৩৩৯খ) এর সংশোধনের মাধ্যমে অনুপস্থিত বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। অনুপস্থিত আসামির বিচারে ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা কেবল দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারী এক প্রক্রিয়ার নাম। এখন থেকে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা জারির কোনো আবশ্যকতা আর থাকবে না। ফলে পলাতক আসামির মামলা দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে।একইসঙ্গে পলাতক আসামিকে আদালেত উপস্থিত হওয়ার আদেশ দুটি পত্রিকার পরিবর্তে একটি বাংলা পত্রিকায় এবং পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।

ফৌজদারি মামলা আপোষ সহজীকরণ

(ধারা ৩৪৫)এর সংশোধনের মাধ্যমে আপস সংক্রান্ত নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে;

ধারা ১৪৩ এখন আপসযোগ্য

    • আগে বেআইনি সমাবেশের অপরাধ আপসযোগ্য ছিল না, এখন এটি আপসযোগ্য করা হয়েছে।
    • আগে এই ধারা আপসযোগ্য না হওয়ায় অনেক মামলা আপসে নিষ্পত্তি করা যেত না।

আদালতের আপসে ভূমিকা

    • আদালত এখন সরাসরি আপস কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে পারবে।
    • জেলা লিগ্যাল এইড অফিসেও মামলা আপস করার নিমিত্ত আদালত প্রেরণ করতে পারবে।

আপস-চুক্তি নথিভুক্তকরণ ও বাস্তবায়ন

    • আপসের ভিত্তিতে কোনো চুক্তি হলে, আদালত সেটি নথিভুক্ত করবে।
    • চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে আদালত প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

আগের সমস্যা ও নতুন সুবিধা

    • আগে আপস হলেও চুক্তি লিপিবদ্ধ না করায় অনেক আসামি কিস্তিতে কিছু টাকা দেওয়ার পর বন্ধ করে দিতেন।
    • তখন আপস-প্রক্রিয়া থামিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ করে রায় দিতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ।
    • এখন চুক্তি থাকলে আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াই সরাসরি চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

বেত্রাঘাত শাস্তি বিলুপ্ত

ধারা ৩৯০-৩৯৫ এর বিলুপ্তি করা হয়েছে এবং ধারা ৩৯৬ এর সংশোধনের মাধ্যমে বেত্রাঘাত শাস্তির বিলোপ করা হয়েছে।

আপিল অযোগ্য জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি

(ধারা ৪১৪) এর সংশোধনের মাধ্যমে এখন থেকে স্যামারি ট্রায়ালে শুধু ৫ হাজার টাকা এর কম জরিমানা করা হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। পূর্বে এটি ২০০ টাকা ছিল।

জামিন ও বন্ড বিষয়ে সংশোধনী (ধারা ৪৯৮)

এখন থেকে যেকোনো আদালত জামিন দেওয়ার সময় যৌক্তিক ও ন্যায্য শর্ত আরোপ করতে পারবে—

    • আসামি যাতে পলাতক না হয় তা নিশ্চিত করতে।
    • আসামির সদাচরণ বজায় রাখতে।
  • যেমন: মামলার চলাকালে ডোপ টেস্ট করা, সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশ নেওয়া, পাসপোর্ট জমা দেয়া, নির্দিষ্ট এলাকা ত্যাগ না করা, সদাচারণ করা ইত্যাদি শর্ত।

(ধারা ৪৯৯) এর সংশোধনীর মাধ্যমে এই ধারায় উল্লেখিত বন্ড আসামি নিজে, তার আইনজীবীর মাধ্যমে, বা আদালত অনুমোদিত অনলাইন সিস্টেমে দাখিল করতে পারবে। তবে জামিনদারের পরিচয় ও যোগ্যতা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা অন্য উপযুক্ত মাধ্যমে যাচাই করতে হবে।

ব্যক্তিগত হাজিরা শিথিল ও সাক্ষ্যগ্রহণে নতুন সুযোগ (ধারা ৫৪০ক)

পূর্বের সমস্যা

    • মামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই আসামিকে বারবার ব্যক্তিগত হাজিরা দিতে হতো।
    • হাজিরা না দিলে ওয়ারেন্ট জারি হতো।
    • জামিনপ্রাপ্ত আসামিরও এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি ছিল না।

নতুন সংশোধনী (ধারা ৫৪০ক)

    • আদালত চাইলে তদন্ত রিপোর্টের শুনানি পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে।
    • এই সময় আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন। আগে কিছুক্ষেত্রে আদালত ধারা ২০৫ অনুযায়ী এ সুবিধা দিতে পারতো, কিন্তু তা কেবল মামলা আমলে নেওয়ার পর প্রযোজ্য ছিল; তার আগে নয়।নতুন বিধানে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ায় সারাদেশের লাখো আসামি উপকৃত হবেন।

সাক্ষ্য গ্রহণের সময় নতুন সুযোগ

    • এখন থেকে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে আসামি উপস্থিত না থাকলেও, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আসামির আইনজীবী সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন
    • আগে অন্তত একজন আসামির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল।

সাক্ষীর খরচ ও সুরক্ষা (ধারা ৫৪৪)

সাক্ষীর খরচ প্রদানের সহজীকরণ

    • আগে ধারা ৫৪৪-এ সাক্ষীর খরচ প্রদানের বিধান থাকলেও, তা কার্যকর করতে পৃথকবিধি প্রণয়ন বাধ্যতামূলক ছিল। এখন থেকে সরকারি আদেশ দিয়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, যা প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও সহজ করবে।

সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষা

    • আগে বিশেষ কিছু আইনে সাক্ষী সুরক্ষার বিধান থাকলেও, ফৌজদারি কার্যবিধিতে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
    • নতুন সংশোধনীতে আদালতকে সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষায় যেকোনো প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে সবধরনের ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তফসিল সংশোধনপূর্বক দণ্ডবিধির ৩২৫ জামিন অযোগ্যকরণ;

ধারা ৩২৫ আগে জামিনযোগ্য ছিল। ভোতা অস্ত্রে হাত-পা ভাঙা বা চোখ-কান হারানোর মতো গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রেও আসামি সহজেই জামিন পেত। প্রাথমিকভাবে ৩২৬ ধারায় মামলা হলে জামিন পাওয়া কঠিন হতো, কিন্তু পরে অস্ত্রের প্রমাণ না মিললে আসামি সুবিধা পেত।

নতুন সংশোধনী

    • এখন ধারা ৩২৫-কে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। ফলে গুরুতর জখমের ক্ষেত্রে কি অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল জামিনের ক্ষেত্রে আর তা বিবেচ্য হবে না।

লেখক : মতিউর রহমান; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বাগেরহাট।