ঢাকা, ৪ নভেম্বর ২০২৫: অর্থঋণ আদালত এখন থেকে ঋণখেলাপিদের বিদেশে পাচার করা অর্থ ও অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধান করতে পারবে। ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ায় এ ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে।
নতুন এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে আদালত জানতে পারবে কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ অপব্যবহার করে দেশে বা বিদেশে সম্পদ অর্জন করেছে কিনা, এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই সম্পদ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে পারবে।
সরকারের লক্ষ্য—এই আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি আনা।
খসড়াটি ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করে অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো আপত্তি না থাকলে এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
খসড়া পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নতুন অধ্যাদেশে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব রয়েছে। অর্থঋণ আদালত প্রয়োজনে খেলাপিদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল আশা করা হচ্ছে—
১. খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে,
২. নির্বাহী সহায়তার মাধ্যমে প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে,
৩. আর্থিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় সুশাসন ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
ড. মনসুর আরও বলেন, “এই পরিবর্তনগুলো ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে এবং শ্রেণীকৃত ঋণ কমাতে সহায়ক হবে।”
আরও পড়ুন : বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে। সেখানে খেলাপি ঋণের মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে, বিশেষ প্রয়োজনে আরও ৩০ দিন সময় বাড়ানো যাবে। নির্ধারিত সময় ভঙ্গ হলে আপিলের সুযোগ থাকবে।
এক তরফা ডিক্রি বাতিলের আবেদনে জামানতের হারও বাড়ানো হচ্ছে—আগে যেখানে ১০ শতাংশ জমা দিতে হতো, সেখানে এখন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হবে।
এছাড়া নতুন করে ‘রিকভারি সার্টিফিকেট’ প্রক্রিয়া চালু করা হচ্ছে, যা পরিচালনা করবেন রিকভারি অফিসার।
একাধিক কার্যকর মামলা দায়েরের প্রথা বাতিলের বিধানও রাখা হয়েছে। কার্যকর প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, প্রয়োজনে ৬০ দিন বাড়ানো যাবে।
অধ্যাদেশে জামানতদারদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং আদালতকে অন্তর্বর্তী আদেশ (যেমন: সম্পদ জব্দ, রিসিভার নিয়োগ, তথ্য প্রকাশের নির্দেশ, দেওয়ানি আটকাদেশ ইত্যাদি) প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সর্বোচ্চ আটকাদেশের মেয়াদও ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হচ্ছে।
আদালত গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ বিচারকদের একটি পুল থেকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হবে। পাশাপাশি ‘অর্থঋণ আপিল আদালত’ গঠনের বিধানও খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে সরকার ‘অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে খেলাপি ঋণের জন্য পৃথক আদালত গঠন ও বড় খেলাপিদের তথ্য নিয়মিত প্রকাশের প্রস্তাব ছিল, তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
আরও পড়ুন : আরপিও সংশোধন ২০২৫: জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোটের বিধান
বর্তমানে দেশের অর্থঋণ আদালতগুলোতে প্রায় ২০ হাজার ৫৯৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৩,২৬৯টি মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৪২টি মামলা। শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৮,৫৭৮।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আদালতের রায় বা আদেশের পর খেলাপিরা নিয়মিত রিট করে সময়ক্ষেপণ করছেন, যদিও আইনে বলা আছে—এই রায় উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। রিটের মাধ্যমেই মামলাগুলো বছরের পর বছর বিলম্বিত হচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শীর্ষ খেলাপিদের অনেকের মামলায় একাধিক রিট দায়ের করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় আটটি পর্যন্ত রিট করা হয়েছে। আবার শুনানির তালিকায় থাকলেও কার্যতালিকার নিচের দিকে থাকায় অনেক মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার এখন অর্থঋণ আদালতকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “অর্থঋণ আদালতকে অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়ার চেয়ে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে ট্রাইব্যুনালে বিচার করার ব্যবস্থা করা গেলে আরও কার্যকর হতো। ট্রাইব্যুনালে গেলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না, ফলে মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। আর ২০২৫ সালের জুনে তা লাফিয়ে বেড়ে হয় ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খেলাপি ঋণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
সরকারের অভিমত—অর্থঋণ আদালতের নতুন ক্ষমতা বাস্তবায়িত হলে ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙবে এবং ব্যাংক খাতে নতুন করে আস্থা ফিরবে।

