ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে এক নারী দুই হাতে দুই যুবককে পেছন থেকে ধরে টানছেন। যুবক দুজন ছোটার জন্য ছটফট করছেন—এ রকম একটা দৃশ্য চোখের সামনে পড়লে আপনার অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে? হয়তো অনেকেই নাটক-সিনেমার শুটিং হচ্ছে বলে ধরে নেবেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোনালিসা বেগম এই গল্প শোনাতে শোনাতে হেসে দিলেন। বললেন, ‘বুঝলেন, কাকরাইল দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি কারা যেন গাড়ি ভাঙছে। সঙ্গের বডিগার্ডকে (পুলিশ কনস্টেবল) বললাম নেমে ধরতে, আমিও দৌড় লাগালাম। পরে দুজন মিলে চারজনকে ধরে ফেললাম। পরে রমনা থানায় মামলা হলো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাসের ফল প্রকাশের আগে ২৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। প্রথম পছন্দ ছিল পুলিশ ক্যাডার। জীবনের প্রথম চাকরির পরীক্ষাতেই পাস। রাজশাহীর সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগে যোগদান করেন, এরপর ঢাকা জেলা, ডিএমপি সদর দপ্তর হয়ে এখন কাজ করছেন মতিঝিল বিভাগে। রাজনৈতিক জ্বালাও-পোড়াওয়ের দিনগুলোতে রমনা বিভাগে কাজ করেছেন প্রচণ্ড চাপ নিয়ে। মোনালিসা বললেন, ‘পেট্রোল বোমাবাজদের ধরতে সাংবাদিকদের পিছে পিছে ঘুরতে হয়েছে। কী যে একেকটা দিন গেছে!’
পুলিশের চাকরি পাওয়ার পরে প্রথম হত্যা মামলাটার সমাধান করতে পেরেছিলেন এক রাতের মধ্যেই। সেই রাতের অভিজ্ঞতা এখনো কাজে দেয়। তিনি বলেন, ‘ইস্কাটনে সন্ধ্যার পরপর একটা হত্যার খবর পেলাম। গিয়ে দেখি পাঁচতলার মেঝে রক্তে ভাসাভাসি, তার ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন এক আদিবাসী নারী। কিন্তু ঘটনাস্থলে কোনো সূত্র পাচ্ছিলাম না। এমনকি যে অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেটিও ঘটনাস্থলে পাচ্ছিলাম না। তখন রমনার ডিসি (উপকমিশনার) ছিলেন আতিক স্যার (আতিকুল ইসলাম, বর্তমানে ডিআইজি হাইওয়ে)। স্যার বারবার বলছিলেন, হত্যা মামলা তদন্তে ঘটনাস্থলই হচ্ছে সবচেয়ে মুখ্য। গুরুত্বপূর্ণ কোনো সূত্র না পাওয়া পর্যন্ত যেন সেখানেই থাকি। বাড়িটির রান্নাঘরের প্রতিটা ছুরি, বঁটি পরীক্ষা করলাম, কিছুই পেলাম না। একটু পরে দেখি রান্নাঘরে থাকা বঁটির ওপর কালচে লাল রঙের মরিচার মতো একটা আস্তর শুকিয়ে এসেছে। বুঝলাম রক্তের দাগ, নিশ্চিত হলাম বাড়িরই কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরে বাথরুমে ভেজানো কাপড় পরীক্ষা করে সেসবের মধ্যে গৃহকর্মীর কিছু রক্তের দাগ লাগা পোশাক পাওয়া গেল। এরপর গৃহকর্মীকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে পুরো ঘটনাটি উদ্ঘাটিত হলো।’
ঢাকা জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করার সময় কেরানীগঞ্জের এক পরিবারের দুই শিশুসহ চারজনকে একসঙ্গে খুন করা হয়। ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এ ঘটনা ঘটে। সেই মামলা তদন্তের দল গঠন থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত পর্যালোচনা করতে হয়েছে। একপর্যায়ে নিজেই দলবল নিয়ে গেছেন সিরাজগঞ্জের চৌহালির চরে আসামি ধরতে।
মোনালিসা বলেন, ‘ওই এলাকায় কেবল পানি আর ধু ধু চর। মাথা জাগিয়ে রাখা একটা ছোট্ট চরে একটা বাড়ি। আমরা তিন দিন ধরে কেবল নৌকা নিয়ে এক চর থেকে আরেক চরে ঘুরছি। যেখানেই যাই, শুনি আসামিটা এইমাত্র পালিয়েছে। আসলে সেখানে নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়ার কোনো পথ নেই। আর আসামি নৌকার শব্দ পেয়েই পালিয়ে যায়। তিন দিনে তিন-চার ঘণ্টা করে ঘুমাতে হয়েছে। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হলো। ঢাকায় ফেরার চার ঘণ্টার মধ্যে আবার খবর এল এই আসামি পালিয়ে পাবনার বেড়ায় গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবারও ছুটতে হলো। এবার আসামি ধরা পড়ল।’
ওই মামলাটার সব আসামিই ধরা পড়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে বিচারও হয়েছে। পাঁচ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর ওই আসামিদের সূত্র ধরে আরও দুটি ডাকাতি মামলা উদ্ঘাটিত হয়েছে। ওই চক্রটা ছিল পেশাদার ডাকাত। পরিবারসহ যে লোককে খুন করা হয়, তিনিও ছিলেন ওই ডাকাত চক্রেরই সদস্য। নিজেদের ভাগাভাগির ঝামেলায় ওই হত্যার ঘটনা ঘটে।
অপরাধ আর অপরাধীদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সংসারে সময় দেওয়া হয় অনেক কম। পাঁচ আর আট বছর বয়সী দুই সন্তানের মা মোনালিসা বেগম। মায়ের ওই রুটিনে ছেলেমেয়ে এবং তাদের বাবাও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সবাই মেনে নিয়েছে ভালোভাবে। কেবল ছেলে মাঝে মাঝে অনুযোগ করে। তবে সব মিলে নিজের পুলিশজীবন বেশ উপভোগ করেন। বললেন, এখানে মানুষকে সহায়তা করার অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে মেয়েদের। মেয়েদের নির্যাতনের ঘটনাগুলো একজন মেয়ে হিসেবে যতখানি অনুভব করা যায়, অন্যদের জন্য সেটা কঠিন।
৫ নভেম্বর যখন মোনালিসা বেগমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তার কিছুক্ষণ আগেই খবর পেয়েছেন, আগের কর্মস্থলের (রমনা বিভাগের) এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে গেছে। বলছিলেন, ‘পাঁচ বছর আগের ঘটনা। শুকনো-লম্বা মেয়েটার চেহারা এখনো চোখে ভাসে। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। আসলে সবার হাতে তো সবকিছু থাকে না।’
কিশোরগঞ্জের মেয়ে মোনালিসা বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় মা বলতেন সন্ধ্যার আজানের আগেই বাড়ি আসবি। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই একটা বিশাল অ্যাডভেঞ্চারের মতো ছিল। এখন তো রাতবিরেতে ঘুরে বেড়াতে হয় কর্মের খাতিরেই। এখন মাকে সেটা বলি মাঝে মাঝে।’
কৃতজ্ঞতা- প্রথম আলো