জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগে রাজধানীর গুলশান ও ধানমন্ডিতে অবস্থিত লেকহেড গ্রামার স্কুলের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রমের অভিযোগ ছিল। দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত অনেকে জঙ্গিই এই স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও নব্য জেএমবির সদস্যদের অনেকেরই এই স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। আর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা ও আনসার আল বাইয়্যাত আর মাকদিস নামে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল এই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠাতাসহ লেকহেড স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে এই স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিজওয়ান হারুন ও গোলাম মাওলা। সর্বশেষ আত্মগোপনে যাওয়ার আগে এই স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন রিজওয়ান হারুন। অন্যদিকে এই স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশে কার্যক্রম চালুর নেপথ্য নায়ক গোলাম মাওলার স্ত্রী জেনিফার আহমেদ। হিযবুত তাহরীর ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বাংলাদেশসহ আল-কায়েদার বিভিন্ন শাখা ও আইএসের অনুসারী নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কাজ করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মঙ্গলবার এই স্কুলের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ঢাকার জেলা প্রশাসক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলা প্রশাসকের হয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় স্কুলটি সিলগালা করে দেয়। এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি স্কুলটির অ্যাডমিনের দায়িত্বপালনকারী একজনের হেফাজতে দেওয়া হয়।
ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস মেহেদী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে লেকহেড গ্রামার স্কুলের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্কুলটি আমাদের বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে। আমরা প্রতিষ্ঠানটির দু’টি শাখার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন অ্যাডমিনের জিম্মায় স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি রেখে আসা হয়েছে। তার কাছ থেকে বুধবার (৮ নভেম্বর) থেকে অ্যাকাডেমিকসহ সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে লিখিত নেওয়া হয়েছে। এর ব্যতিক্রম হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে ধানমন্ডির ৬/এ সড়কে প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্কুলটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হিযবুত তাহরীরের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী জেনিফার আহমেদ। বর্তমানে ধানমন্ডির ১১/এ সড়কে ও গুলশানের ১৩৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত স্কুলটি শুরু থেকেই জঙ্গিবাদে মদদ দিয়ে আসছিল। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর প্রথম আলোচনায় আসে এই স্কুল। ওই সময় স্কুলটি পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব নেয় হারুন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কর্ণধার হারুন অর রশিদ ও তার ছেলে রেজোয়ান হারুন। এরপর থেকে এই স্কুলে আরও বেশি জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ বাড়তে থাকে।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, লেকহেড স্কুলের এক সময়ের চেয়ারম্যান লতিফ আহমেদ হলো প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদের বাবা। তার আরেক সন্তান সাব্বির আহমেদও এই স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এছাড়া আরেক অধ্যক্ষ ফারজানা আহমেদের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গোলাম মাওলা-জেনিফার আহমেদ দম্পতির সূত্র ধরেই এই স্কুলে হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ নেতা মনিরুজ্জামান মাসুদ, নাঈম, জুবায়ের কৌশিক, জাহিদুর রহমান, মৌমিতাসহ আরও অন্তত দু’জন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে হিযবুতের তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
ওই প্রতিবেদনের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল বাইয়্যাত আল মাকদিসের আলী হাসান মাহমুদ রিপন, রাফায়েল, সাদ্দামও এই স্কুলের সাবেক শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিল। এছাড়া আল-কায়েদা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলা বা একিউএপি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজীব করিম ছিল এই স্কুলের সাবেক শিক্ষক। যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গ্রেফতারের পর সে বর্তমানে ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি। রাজীব করিমের ভাই তেহজিব করিম, তেহজিবের স্ত্রী সিরাত করিমও এই স্কুলের সাবেক শিক্ষক। ২০১০ সালে ইয়মেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযোনে গ্রেফতার হয়েছিল তেহজিব। তেহজিবের শ্বশুর এ রশিদ চৌধুরীও এই স্কুলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সূত্র জানায়, পরিবারসহ সিরিয়ায় চলে যাওয়া মাইনুদ্দিন শরীফ, তার ভাই রেজোয়ান শরীফ, ফারজাদ হক, রিফাত, রিফাতের ভাই সাদমান, তাসনুভা, ইয়াসিন তালুকদার, আরিফুর রহমান ও আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে সিরিয়ায় চলে যাওয়া জুবায়েদুর রহিমও এই স্কুলের সাবেক শিক্ষক। ২০১৪ সালে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আহমেদ ওয়াদুদ ওরফে জুম্মন ওরফে সাইফুল ওরফে অর্ণব এই স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। তারা ছাড়াও লেকহেড গ্রামার স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজোয়ান হারুনের সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ কারাবন্দি জসিমউদ্দিন, মালোশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো আনসারুল্লাহর শীর্ষ জঙ্গি রেজওয়ানুল আজাদ রানা, পাকিস্তানে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া ইফতেখার আহমেদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘গত বছর হলি আর্টিজানে হামলার পর দেখা যায় নব্য জেএমবির সদস্য ও হোলি আর্টিজান হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা হিসেবে শনাক্তকারী সেনবাহিনীর সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও এই লেকহেড স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিল। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে জাহিদ মারা যাওয়ার পর লেকহেড স্কুল আবারও নতুন করে আলোচানায় আসে।’ মূলত এরপর থেকেই জঙ্গি কার্যক্রমের আখড়া হিসেবে পরিচিত এই স্কুল বন্ধের জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক প্রতিবেদন দেয় বলেও ওই কর্মকর্তা জানান।
-বাংলা ট্রিবিউন
সম্পাদনা- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম