২০১২ সালে ফৌজদারী আইন সংশোধন করে জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে যেসব উপজেলা রয়েছে সেসব উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। তার মধ্যে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা অন্যতম হওয়ায় ২০১২ সালে নভেম্বর মাসে ৩ হাজার ৬শ’ দেওয়ানী মামলা নিয়ে দেওয়ানি আদালত দৌলতপুরে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে গত ৫ বছরেও ফৌজদারী আদালত স্থানান্তর হয়নি। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ ও নির্দেশের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে ফৌজদারি আদালত আজও কুষ্টিয়া জেলা শহরেই রয়ে গেছে। ফলে জেলা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলার বিচার প্রার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে আসছে। এ নিয়ে একাধিকবার বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধনও হয়েছে; তাতেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোন টনক নড়েনি।
গত ২৪ জানুয়ারী’২০১৭ সোমবার সন্ধায় কুষ্টিয়ার তৎকালীন জেলা জজ মো: বারেকুজ্জামান, চিফ জুডিশিয়াল ম্যজিষ্ট্রেট মাহমুদা খাতুনসহ বিভিন্ন আদালতের একাধিক বিচারক দৌলতপুর দেওয়ানী আদালত ও ফৌজদারী আদালতের স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময় দৌলতপুরের সিনিয়র সহকারী জজ মো: ফয়সাল আল মামুন, আইনজীবী, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় এলাকাবাসী অবিলম্বে দৌলতপুরে ফৌজদারী আদালত কুষ্টিয়া থেকে স্থানান্তরের জোর দাবী জানান। কিন্তু আদালত ভবনে সাব-রেজিষ্টার অফিস রয়েছে এ ছুঁতো ধরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফাইল চালাচালি শুরু করে।
উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে তারাগুনিয়া বাজারের পাশে একটি ভাড়া করা বাড়িতে দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে উপজেলা চত্বরের একটি ভবনে সহকারী জজ আদালতের কার্যক্রম চালু করা হয়। ১৯৯৩ সালের দিকে আদালতটি জেলায় স্থানান্তর করা হয়। যে দুটি কক্ষে আদালতের কার্যক্রম চলত, সেখানে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। ২০১২ সালে উপজেলা সহকারী জজ আদালত আবার উপজেলা চত্বরে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় স্থানীয় সাংসদ আফাজ উদ্দীন আহম্মেদ আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়টিকে নিজের বাড়ির কাছে তারাগুনিয়ার একটি ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তর করান। ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে সেখানে কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যালয় স্থানান্তরের প্রতিবাদে খায়রুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট করেন। রিটের বিষয়বস্তু হচ্ছে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসটি যেন উপজেলা সদরেই রয়ে যায়। আদালত ১৬ জানুয়ারি থেকে উপজেলা চত্বরের সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের ওপর ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন। মাঝে দুবার স্থিতাবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধি হওয়ায় ২০১৪ সালের ২০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এরপর থেকে ওই রিট বিষয়ে আর কোন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে বর্তমান স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসটি আদালতের রুমগুলো থেকে সরিয়ে অন্যত্র জায়গা নির্ধারন করে দিয়ে ও সেখানে সংস্কার কাজে দুলক্ষ টাকা বরাদ্দ দিলেও সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ও অনিচ্ছার কারনে নির্ধারিত জায়গায় স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।
জেলা আওয়ামীলীগ নেতা ও কুষ্টিয়া জজ কোর্টের তরুণ আইনজীবী হাসানুল হাসকার হাসু জানান, সাধারণ মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে উপজেলা সদরে দেওয়ানী আদালতের মতো ফৌজদারী আদালতসহ একটি পূর্নাঙ্গ আদালত ব্যবস্থা স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশেষ সুনজর কামনা করেন।
দৌলতপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন বলেন, ৪৬১ বর্গ কিলোমিটারের বৃহৎ এ উপজেলায় প্রায় ৬ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এখানকার অধিকাংশ জনগণ দরিদ্র এবং কৃষিজীবী। তাদের পক্ষে জেলা সদরে গিয়ে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা করা অত্যন্ত ব্যয় বহুল ও কষ্টসাধ্য। সেকারণ বর্তমান সরকার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন করে দৌলতপুরে আদালত স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেও শুধুমাত্র সাব-রেজিষ্টার অফিসের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারনে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
দৌলতপুর উপজেলার প্রবীন সাংবাদিক ও আইনজীবী এম.জি মাহমুদ মন্টু জানান, কুষ্টিয়ার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ এবং বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আন্তরিক হলেই সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের ব্যবহারকৃত রুমগুলো মুহূর্তের মধ্যেই অপসারণ করে সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে রয়েছে। জেলা শহর থেকে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী উপজেলা শহরে দেওয়ানী আদালতের মত ফৌজদারী আদালত স্থানানন্তর হলে বিচারক ও আদালতের ষ্টাফদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াত নিয়ে শংকা থেকেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আগ্রহ দেখান না বলে জানা যায়।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম