Abuse

নারী নির্যাতন: মাঠ পর্যায়ে নেই প্রতিরোধ!

এক লাখ টাকা যৌতুক দেওয়ার শর্তে এক ড্রাইভার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন রাজিয়া। যে বাসা-বাড়িতে তিনি কাজ করেন তাদের সহায়তা ও সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে যোগাড় করেন যৌতুকের টাকা। এছাড়া, আরও কুড়ি হাজার টাকা খরচ হয় বিয়েতে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই মেয়ে ফিরে আসে রাজিয়ার কাছে। আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা চায় জামাই। ঢাকার নিম্নবিত্তের মানুষেরা সন্তানের ঘর বাঁধতে যৌতুকের লেনদেন করেন ঠিকই এবং বিভিন্ন কারণে ঘটনা জানাজানিও হয়। তবে মধ্যবিত্তের যৌতুক চলে চোখের আড়ালে। আইন, মানবাধিকার সংগঠনের লম্বা তালিকার পরও প্রতিনিয়ত যৌতুকের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছেন নারী, হত্যার শিকার হচ্ছেন গৃহবধূ,কখনও মায়ের হাতেই খুন হচ্ছে শিশু।

সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন দিয়ে সব সুরাহা হয় না। সামাজিক প্রতিরোধ থাকা এবং দৃশ্যত এই প্রতিরোধ জারি আছে বলে সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। কিন্তু গত একদশকে মাঠের সেই প্রতিরোধ নেই। যেটুকু আছে সেটা দায়সারা কর্মসূচিভিত্তিক। তারা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের পর নারীর অধিকার আদায়ে সংগঠনগুলো যে পরিমাণ সরব থাকতো, এখন তেমন সক্রিয়তা নজরে আসে না। তাদের কাজের পরিসরও অনেকটাই কর্মসূচি কেন্দ্রিক হওয়ায় যৌতুক ও নারী নির্যাতনের অন্যান্য হাতিয়ারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়৷ ১০৮ জন নির্যাতনের শিকার হয়ে বেঁচে আছেন৷ যৌতুকের মামলা হয়েছে মোট ৯৫টি। এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যা, বাল্যবিবাহ, অপহরণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে ১৫৬৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ বছরে হত্যার শিকার হয়েছেন ১১৫১ জন নারী।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শনিবার (২৫ নভেম্বর) পালিত হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আজ থেকেই শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষেরও। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ পক্ষ পালিত হবে। দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘কেউ রবে না পিছে, নারী ও শিশু নির্যাতনমুক্ত জীবন চাই’। এই দিনটি মূলত তাদের সহায়তার জন্য- যারা তুলনামূলক বেশি ভঙ্গুর। আন্তর্জাতিকভাবে সবাইকে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয় কমলা রংয়ের মাধ্যমে নিজেদের সক্রিয়তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদযাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করে আসছে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালায়। ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ নামের এই জরিপ অনুযায়ী দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনও না কোনও সময়ে, কোনও না কোনও ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ সংক্রান্ত ২০১৫ সালের জরিপে অংশগ্রহণকারী বিবাহিত নারীদের ৫০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ২৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্যাতন করেন,এমন ঘটনা ১৫ শতাংশ । ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীরা নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন সবচেয়ে বেশি।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘নারী-পুরুষের সমতার অভাব, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য দায়ী। নারীকে সুরক্ষিত করতে আইন যথেষ্ট আছে। কিন্তু যতটা সামাজিক আন্দোলন জরুরি- সেটা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে বলা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর আইন থাকলেও নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার অভাবে আইনি সহায়তা নিতে আগ্রহী হয় না। সেক্ষেত্রে তাদের সেই সুবিধাটি নেওয়ার বিষয়ে সচেতন করাটাও একটি কাজ। সেই কাজটি কারও একার পক্ষে করা সম্ভব না। নব্বইয়ের দশকে নারী অধিকার আন্দোলনের যে জোয়ার লক্ষ্য করা গেছে, সেটি এখন অনেক কম। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা পরিমাণগতভাবে যে কমেছে, তা বলা যাচ্ছে না।’

নারীর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধে সোচ্চার থাকা যেমন জরুরি, তেমন আছে বলা যাবে না। আমরা একটি ইস্যুতে একত্র হই, আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। মাঠে প্রতিরোধ নেই তা বলবো না, তবে মাঠের প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা নেই বলা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন দরকার, সেটি আমরা অব্যাহত রাখতে দেখিনি। কিন্তু তারপরও বেশকিছু কাজ চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায় অনেক। সেখান থেকে মূল উদ্যোগটি আসলে নারীর প্রতি সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘এখনকার মানবাধিকার সংস্থা ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো অনেক বেশি কর্মসূচিভিত্তিক কাজ করছে। ফলে যা কিছু তাদের কর্মসূচির মধ্যে নেই, সেগুলো নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। কাজ এখনও যেহেতু শেষ হয়নি, প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে সার্বিকভাবে সক্রিয় হতে হবে।’

(উদিসা ইসলাম/ বাংলা ট্রিবিউন)