থানা-পুলিশের তদন্তে ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ত্রুটি, ম্যাজিস্ট্রেটের ভুল এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে ৫৩ শতাংশ হত্যা মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান।
পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থাপুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সম্প্রতি এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। একই গবেষণায় এসেছে, বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে ৩৭ শতাংশ হত্যা মামলায় সাক্ষীরা আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে তদন্তের সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা এবং তদন্তের বিষয়ে তাদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্তের জন্য পুরস্কার, তিরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা আরও জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকের দক্ষতায় ঘাটতির পাশাপাশি কারও কারও নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। কারও ভুলের কারণে যদি আসামি সুবিধা পান, তার দায়টা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। কিন্তু এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হয়েছে—এমন নজির সচরাচর দেখা যায় না।
পুলিশের তদন্তের পর আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারের চিত্র পর্যালোচনা করতে পিবিআই এই গবেষণা করে। এর অধীনে দেশের ৮ বিভাগ থেকে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করা ৮ জেলার ২০১৫ ও ২০১৬ সালে নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ২৩৮টি মামলার রায় পর্যালোচনা করা হয়।
গবেষণায় এসেছে সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বগুড়া ও খুলনা জেলার এই ২৩৮টি হত্যা মামলার মধ্যে ১২৩টি অর্থাৎ প্রায় ৫২ শতাংশ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়েছেন। এর মধ্যে ১১১টিতেই তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কোনো না কোনো ভুল পেয়েছে পিবিআই। খালাস হওয়া মামলার মধ্যে মাত্র ১৫টি অর্থাৎ ১২ শতাংশ মামলায় বাদী, সাক্ষী ও রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণে সচেষ্ট ছিল।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মামলা প্রমাণ করতে বিভিন্ন ধাপে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করায় আসামি ছাড়া পেয়ে যান। হত্যা মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে যদি অর্ধেকের বেশি মামলায় আসামি খালাসই পেয়ে যান, তাহলে এই বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না। তিনি এই গবেষণা থেকে সংশ্লিষ্ট সবার শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানান।
পিবিআই সূত্র জানায়, তাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল সুপারিশসহ গত ১৯ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর, এসবি, সিআইডি, পুলিশ একাডেমিতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ স্টাফ কলেজগুলোতেও পাঠানো হবে। এ বিষয়ে গত শনিবার জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপরাধ) আবু হাসান মাহমুদ তারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেকশনে হয়তো জমা দিয়েছে। আমি এখনো দেখিনি।’
পিবিআইয়ের পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান অনুযায়ী, খালাস পাওয়া ১২৩ মামলার মধ্যে সাক্ষী বৈরী হওয়ার কারণে ৪৫টিতে (৩৭ শতাংশ), তদন্তে ত্রুটি থাকার কারণে ১৬টিতে (১৩ শতাংশ), ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ত্রুটি থাকার কারণে ১৪টিতে (১১ শতাংশ), তদন্তে ত্রুটি ও বৈরী সাক্ষী উভয় কারণে ৩২টি (২৬ শতাংশ), ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ৪টি (৩ শতাংশ) এবং অন্যান্য কারণে ১২টিতে (১০ শতাংশ) আসামি খালাস পেয়েছেন।
পিবিআইয়ের প্রধান, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার বিভিন্ন ভুলের কারণে মামলার ক্ষতি হয়, আসামিপক্ষ সেই সুযোগটাই গ্রহণ করে। তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত সম্পূর্ণ করতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশের তদন্ত এখন অনেকটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনভিত্তিক হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মামলা প্রমাণে অভিযোগপত্রে নিজেদের তদন্তে প্রাপ্ত ফলাফলের পক্ষে শক্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে হবে। এমনকি সাক্ষী যাতে সাক্ষ্য দিয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারেন, সে জন্য এর পক্ষেও প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ত্রুটি
শুধু মামলার তদন্তে ভুল থাকার কারণে ১৩ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যান। মামলার রায় পর্যালোচনা করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে পিবিআইয়ের গবেষণায়। এতে বলা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিজেরা আদালতে সাক্ষ্য দেন না এবং আদালত থেকে বারবার সমন জারির পরও সাক্ষী হাজির করতে পারেন না। এ ছাড়া ঘটনা প্রমাণ না করেই অভিযোগপত্র দাখিল, খসড়া মানচিত্রে ভুল, নিরপেক্ষ লোক থাকা সত্ত্বেও তাঁদের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না করা, ক্ষেত্রভেদে আসামি বা সাক্ষীদের জবানবন্দি না নেওয়া, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও তদন্তে প্রাপ্ত ফলের মধ্যে সামঞ্জস্য না করা, ঠিকমতো জব্দ তালিকা প্রস্তুত না করা এবং বিশেষজ্ঞের মতামত না নেওয়ার বিষয়ও চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ শতাংশ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য না দেওয়ায় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারায় আসামি খালাস পেয়েছেন বলে আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভুল
খুন, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনোভাবে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইন অনুসারে মৃত্যুর কারণ ও ধরন জানতে মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন ফরেনসিক চিকিৎসকেরা, যা ময়নাতদন্ত নামে পরিচিত। মামলার প্রমাণে এই প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনেক।
গত বছর কুমিল্লায় খুন হওয়া কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশের ময়নাতদন্ত নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ মিললেও তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের কথা আসেনি। এমনকি মৃত্যুর কারণও উল্লেখ করা হয়নি।
২০১৪ সালের ২৯ মার্চ রাজশাহীতে ওয়াহিদা সিফাত নামের এক গৃহবধূর মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে আগের ময়নাতদন্ত ভুল প্রমাণিত হয়। এমন উদাহরণ আরও আছে।
পিবিআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জখমের বর্ণনা, সময়, মৃত্যুর সময়, হত্যা না আত্মহত্যা ইত্যাদি বিষয়ের সঠিক উল্লেখ না থাকার কারণে এবং ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বাস্তব ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিল না থাকার কারণেও মামলার আসামিরা খালাস পান। ১১ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে এমনটা পাওয়া গেছে। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষ্যপ্রমাণ ও পারিপার্শ্বিকতায় হত্যার আলামত পেয়েছেন এবং সেভাবেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
এ ছাড়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ, জব্দ তালিকায় ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর, সুরতহাল প্রতিবেদনে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরের ভুলের কারণেও মামলায় আসামিরা সাজা পান না বলে প্রতিবেদনে এসেছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া এবং তাঁদের মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন বলে মনে করে পিবিআই।
বিচার দীর্ঘায়িত হওয়ায় আপস
মসজিদের পুকুরপাড়ে ৪০-৫০ বছরের পুরোনো একটি কাঁঠালগাছ কাটা নিয়ে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুরে ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে গুরুতর আহত ফয়জুর রহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ফয়জুর রহমানের আত্মীয় মোহাম্মদ আলী পাঁচজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।
থানা-পুলিশ এক বছরের তদন্ত শেষে পাঁচজনকেই আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। ৭ বছর পর মামলার রায়ে সব আসামি খালাস পান। রায়ে আদালত বলেছেন, ১৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনই এজাহারের সমর্থনে সাক্ষ্য দেননি। আদালতের বাইরে বিবাদীরা মামলায় আপস করে থাকতে পারেন।
পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে আদালতে সাক্ষী উপস্থাপন করা থেকে শুরু করে মামলা প্রমাণ করার প্রতিটি ধাপেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মামলার বাদীই সব ধরনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় খালাস বেশি
গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আদালতে যেসব মামলায় সাজা হয়েছে, সেগুলোর বিচারকার্যে গড়ে ৫ বছর এবং যেসব মামলায় আসামি খালাস পেয়েছেন, সেগুলোতে গড়ে ৭ বছর সময় লেগেছে। অর্থাৎ আদালতে বিচারকাজ যত দীর্ঘায়িত হয়েছে মামলায় খালাসের পরিমাণ তত বেড়েছে।
২০১৬ সালে ময়মনসিংহে ৪৯টি হত্যা মামলার রায় হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে এবং ৪৩টিতে আসামি খালাস পেয়েছেন। যেসব মামলায় সাজা হয়েছে, সেগুলোতে বিচারিক কার্যক্রমের সময়সীমা ছিল গড়ে ৭ বছর। আর খালাস হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ১৪টি মামলার বিচারকার্যে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। ১টি মামলায় সর্বোচ্চ ২৪ বছর ৬ মাস সময় লেগেছে।
সিলেট জেলার ৪৬টি মামলার মধ্যে ১৫টিতে সাজা হয়েছে। সাজা হওয়া মামলাগুলোর বিচারকার্যে গড়ে সময় লেগেছে সাড়ে ৪ বছরের মতো। আর খালাস হওয়া মামলায় লেগেছে সাড়ে ৫ বছরের মতো। এর মধ্যে ২টিতে সর্বোচ্চ ১১ বছর সময় লেগেছে।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলছে, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিভাগে একাধিক দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা যেতে পারে। সম্ভব হলে জেলা পর্যায়েও এই আদালত স্থাপন করা যায়। এতে দ্রুত বিচার সম্ভব ও সাজার হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে এবং মামলার জট কমে যাবে বলে পিবিআই মনে করে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যাওয়ার পেছনে তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়া উভয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই দায়ভার রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যাঁদের গাফিলতির কারণে আসামি ছাড়া পাবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। এটা করতে পারলে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। সূত্র- প্রথম আলো
সম্পাদনা – ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম