ক্যাথরিন মাসুদ :
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিম্ন আদালতে মামলা করেছিলাম। জনস্বার্থ জড়িত থাকায় মামলাটি পরে হাইকোর্টে নিয়ে আসি। মামলাটি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে। হাইকোর্টের এই রায় থেকে অবশেষে আমি সান্ত্বনা পেলাম। একটা বড় পদক্ষেপ নিয়ে আমি এগিয়ে এসেছি, কিন্তু আরও বহুদূর আমাদের যেতে হবে।
যে ঘটনায় তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরসহ এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, সেটিকে আমরা বলি দুর্ঘটনা। কিন্তু এটা নিছকই দুর্ঘটনা নয়। এমন ঘটনার পেছনে অনেক মানুষেরই দায়দায়িত্ব আছে। শুধু চালকের নয়। বাস বা ট্রাক কোম্পানি, মালিক, বিমা প্রতিষ্ঠানেরও দায়দায়িত্ব আছে। রায়ের মধ্য দিয়ে আমরা তাদের যতটা দায়বদ্ধ করতে পারব, ভবিষ্যতে তারা ততটাই সতর্ক হবে। আমরা সবাই তাহলে তা থেকে একটি ফল পাব।
যা হারিয়েছি, তা তো আর কখনো ফিরে পাব না। কিন্তু এই রায়ে আমরা তার একটা স্বীকৃতি পেলাম। রায়টাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। আমরা আমাদের কাছের মানুষকে হারিয়েছি। কিন্তু শুধু সেটাই তো নয়। ব্যক্তিজীবনে আর্থিকভাবেও আমাদের ক্ষতি হয়েছে। তারই স্বীকৃতি দিলেন আদালত। দুর্ঘটনার ফলে যে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যায়, মোটরযান অধ্যাদেশেও যে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে, মানুষ এখন সে ব্যাপারে সচেতন হবে। তারা বুঝতে পারবে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদেরও কিছু একটা করার আছে। তবে আমি বলব, এটা আমাদের আংশিক জয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যখন একটি ন্যায়সম্মত ও সঠিক আইনগত প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হবে, পূর্ণ জয় আসবে তখন।
ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে আমি হারিয়েছি। আমাদের ভবিষ্যৎ কাজের যেসব পরিকল্পনা ছিল, সব ভেস্তে গেছে। ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে আমার নিজের যে ব্যক্তিজীবন গড়ে উঠেছিল, তাও তছনছ হয়ে গেছে। আমার পুরো জীবনটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অনেকের ধারণা, তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ অঢেল সম্পদের অধিকারী। তা তো নয়। কখনোই আমাদের তা ছিল না। আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিল না। ভাড়া বাসায় থাকতাম। দুর্ঘটনার পর এক বছরের শিশুসন্তানটিকে নিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে উঠতে বাধ্য হয়েছি। দুর্ঘটনায় আমার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিজের টাকায় চোখে চারটা অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তরুণ বয়স থেকে বাংলাদেশই হয়ে উঠেছিল আমার ঠাঁই। তাই যুক্তরাষ্ট্রে আমার নিজের কোনো জায়গা নেই। সেখানে এখন মায়ের কাছে উঠেছি। সে দেশে একেবারে নতুন করে আমাকে সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছে। অনেকেই এসব কথা জানে না।
তারেক মাসুদ তার পরিবারের বড় ছেলে ছিল। সে চলে যাওয়ার পর তার পরিবারও অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের শক্ত হয়ে উঠতে অনেক সহযোগিতা করতে হয়েছে। তার মা, ছোট ভাই, প্রতিবন্ধী বোনের অনেকটা দায়িত্ব আমাকে নিতে হলো। দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছে, তারা নানা জায়গা থেকে নানাভাবে অনেক সহায়তা পেয়েছে। আমি তো কিছু পাইনি। তারেকের মা আর আমাদের ছেলের জন্যও এমন সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তারেক মাসুদের স্ত্রী