সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ মামলা করবেন যেভাবে

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা আহত হওয়ার ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি চাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ চেয়েও আদালতে মামলা করতে পারেন পরিবার ও স্বজনরা। টর্ট আইনে রয়েছে এই সুযোগ। তবে বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত কোর্ট-ফির কারণে ক্ষতিপূরণ মামলার সংখ্যা কম। এ বিষয়ে দেশের আইনজীবীরাও তেমন আগ্রহ দেখান না বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা হচ্ছে এবং নিজেদের পক্ষে রায়ও পাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের পরিবার ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবে বলে গতকাল রোববার সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্ট তার রায়ের পর্যবেক্ষণে একথা জানান।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। যেহেতু আমাদের দেশে ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩’ নামে একটি আইন রয়েছে। কিন্তু ওই আইন না জানার কারণে তারা (ক্ষতিগ্রস্তরা) কখনও আদালতে আসেনি। তবে এই রায়ের পর থেকে ভবিষ্যতে তাদের আদালতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এখন থেকে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখোমুখি হলে আহত ব্যক্তি তার নিজের পক্ষে অথবা নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পরিবার এই আইনের অধীনে আদালতে আসতে পারবেন।’

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রমজান আলী সিকদার বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের মামলা করতে মাত্র ২০ টাকা খরচ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত যে কেউ বা তার পরিবারের সদস্যরা এ মামলা করতে পারেন।’ এসময় তিনি বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরামর্শও দেন।

প্রথমত, মামলা করতে হলে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সঙ্গে নিয়ে জেলা জজ (পদাধিকার বলে সড়ক দুর্ঘটনার দাবি ট্রাইব্যুনাল) আদালতে হাজির হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আদালত থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের দাবি সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হবে। ফরমের সঙ্গে দুর্ঘটনার প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণাদি যুক্ত করতে হবে।

তৃতীয়ত, যাবতীয় তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে মাত্র ২০টাকা কোর্ট ফি দিয়ে দাবি ফরমটি জেলা জজ (সড়ক দুর্ঘটনার দাবি ট্রাইব্যুনাল) বা সমপর্যায়ের জেলা জজ আদালতে জমা দিতে হবে। এরপর বিচারক তা গ্রহণ করবেন।

চতুর্থত, বিচারক ওই দাবি ফরম গ্রহণ করলে তিনি সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের ওপর সমন জারি করবেন। এরপর দুই পক্ষ আদালতে হাজির হয়ে তাদের আপত্তি উত্থাপণ করবেন।

পঞ্চমত, এ পর্যায়ে আদালত মামলার ধরন নির্ণয় করে দেওয়ানী কার্যাবিধি অনুসারে মামলার বিচার্য বিষয়গুলো গঠন করা হবে এবং মামলার বিচার কাজ শুরু করবেন অথবা প্রয়োজনীয় আদেশ দেবেন।

কে এই মামলা দায়ের করতে পারেন?
মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার পরিবার, আর শারিরীক ক্ষয়ক্ষতি, আহত অথবা কোনও সম্পদের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করে যে কেউই এই মামলা দায়ের করতে পারবেন।

টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা

এ বিষয়ে আইনজীবী খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে ক্ষতিপূরণ মামলা করার প্রচলন তেমন নেই। কারণ ক্ষতিপূরণ মামলা মূলত টর্ট আইনেই করতে হয়। এই আইনের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব, তবে আইনজীবীদের অনীহার কারণে তা ফলপ্রসূ হয় না।’

সাধারণ অর্থে টর্ট বলতে বোঝায় কোনও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। তাই টর্ট আইনেই সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের মামলা করা আইনগত সবচেয়ে ভালো দিক বলে মনে করেন আইনজীবী খলিলুর রহমান।

টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা করার নিয়ম জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কোনও ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, তার পরিবার বা স্বজনরা একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। এক্ষেত্রে দুটি মামলা হতে পারে, একটি নিহতের ঘটনায় বিচারের আর্জি। অন্যটি ক্ষতিপূরণ মামলা।’

মামলা করার ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির পেশা, আয় ও আয়ু বিবেচনা করা হয় বলে জানান আইনজীবী খলিলুর রহমান। অর্থাৎ একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি বেঁচে থাকলে কী পরিমাণ অর্থ আয় করতেন, কতদিন বাঁচতেন ইত্যাদি। তার সেই আয় দিয়ে কী কী হতো এসব তথ্য উল্লেখসহ টর্ট আইনে মামলা করা যায়। তবে টাকার অংক বেশি হলে কোর্ট ফি বেশি হয়। টাকার অংকের ওপর এই ফি নির্ধারণ করা হয়। এর ক্যাটাগরি করা আছে। এই ফি এতই বেশি যে অসচ্ছলদের পক্ষে ক্ষতিপূরণ মামলা করা অসম্ভব। এ কারণেই অনেকে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে যায় না। তাছাড়া সময়ক্ষেপণও হয়।’

আইনজীবী খলিলুর রহমানের ভাষ্য, ‘মামলার পর কবে নাগাদ ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা আসলে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না। এ কারণেই মানুষের মধ্যে এই মামলা করার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর বিষয় অনেকেরই জানা নাই। তাই ক্ষতিপূরণ মামলা করতে কেউ আসে না। ২০১৫ সালের মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ এখনও খসড়া হিসেবেই আছে। তবে এসব আইনের বাইরে গিয়েও টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা যায়। কেউ যদি মনে করেন তিনি কোনও ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন। সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাগুলোতেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার টর্ট আইনে মামলা করতে পারবেন। তাছাড়া গতকাল (রবিবার) আদালত পর্যবেক্ষণে যে রায় দিয়েছেন, সেখানেও ক্ষতিপূরণের মামলা করার সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।’

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হওয়ার নজির কম। আবার কখনও কখনও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমেও মীমাংসা হয়। চালকরা দুর্ঘটনা ঘটালে দায়িত্ব মালিকের ওপর বর্তায় বলে জানিয়েছেন আইনজীবী খলিলুর রহমান। তার কথায়, ‘টর্ট আইনে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে কোন ঘটনায় কার দায়িত্ব কতটুকু তা নির্ণয়ের সুযোগ আছে। চালক কোনও ত্রুটি করলে তার দায় মালিককে নিতে হবে। কারণ মালিক তাকে সচেতন করেননি। এজন্য মালিকই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পাবেনই।’
বাংলাট্রিবিউন