সিরাজ প্রামাণিক
সন্তান নিয়ে স্কুলে প্রবেশকে কেন্দ্র করে সিভিল সার্জন ও এডিসি’র মধ্যে বাকবিতন্ডায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সিভিল সার্জনকে কারাদন্ড দেয়ার রেশ না কাটতেই এবার একজন আইনজীবীকে কারাদন্ড দিলেন একজন এসিল্যান্ড। ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে এসি ল্যান্ডের কক্ষে বসা নিয়ে। সাজা দেওয়ার সময় এসি ল্যান্ড বলেন ‘আমি আমার ক্ষমতা দেখালাম, পারলে আপনি আপনার ক্ষমতা দেখান’। ভ্রাম্যামাণ আদালতে ব্যক্তিগত আক্রোশে সাজা দেয়ার বিষয় নিয়ে চিকিৎসক, আইনজীবী, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের মাঝে চলছে চরম অসন্তোষ। নির্বাহী বিভাগের এসব কথিত বিচারকদের ক্ষমতা দেখানো নিয়ে আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টক শ’ পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। ভ্রাম্যমান বিচার ব্যবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরনের পর প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ডিসি বাহাদুরেরা সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচারের দাবি জানিয়ে ছিলেন। সেসময় বুদ্ধিজীবীরা মত প্রদান করেছিলেন যে, ডিসিদের চাপে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার জন্ম হলে, আম ও ছালা দুটোই যাবে। প্রথম দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছিল তাঁদের জন্য এক সান্ত¡না পুরস্কার। আমাদের কাছে এটা বিষবৃক্ষ। এই বৃক্ষ বিস্তৃত হয়ে চলেছে। বিষবৃক্ষ একটি নয়, দুটি। একটির নাম ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্যটি ২০০৯ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় সংযোজিত ৪ উপধারা। এর অধীনে নির্বাহী হাকিমদের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা বা কগনিজেন্স পাওয়ার অর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা ২০০৭ সালের অধ্যাদেশে ছিল না। ওই দুটি বিষবৃক্ষই বিচার বিভাগ পৃথক্করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) নীতির পরিপন্থী। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের লঙ্ঘন। এ মামলাটি আপিল বিভাগে চলমান। আদালত অবমাননার জন্য আমলারা এখনো কাঠগড়াবিদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে নিচ্ছেন সাধারণতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা। তাঁরা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে নিত্যনতুন আইন ঢোকাতে চেষ্টা করছেন। আর তক্কে আছেন, কখন কোন সুযোগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারার ৪ উপধারার আওতায় কগনিজেন্স পাওয়ার গলাধঃকরণের। ওই মোবাইল কোর্ট আইন এবং ওই ৪ উপধারাটি অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক উৎস।
মোবাইল কোর্টে তাঁরা গোড়াতে শুধু অর্থদ- দেওয়ার ক্ষমতা পান। তফসিলের পেটে ছিল দুই ডজন আইন। নির্বাচিত আমলে তাঁরা অনধিক দুই বছর কারাদ- দেওয়ার ক্ষমতা বাগিয়ে নেন। এটা করে দেশে ‘দ্বৈত বিচারের’ পর ‘দ্বৈত দ-নীতি’ চালু করা হয়েছে। আর এখন পারলে তাঁরা পুরো দ-বিধিটাই ওই তফসিলের পেটে চালান করে দেন। বর্তমানে শতাধিক আইন আছে। আরও তাঁরা বাড়াবেন। এখন নাকি তাঁরা কগনিজেন্স পাওয়ারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। কগনিজেন্স পাওয়ার মানে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, কগনিজেন্স পাওয়ার একটি বিচারিক ক্ষমতা। এটা সর্বতোভাবেই বিচার-প্রক্রিয়ার অংশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই অভিমত দেন। তাহলেই প্রশ্ন, ডিসিরা ও তাঁদের অধীন নির্বাহী হাকিমরা কি বিচারক? ওঁরা বিচারক না হলে ওঁদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে কেন?
নির্বাহী বিভাগ প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ বিচার করবে। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও শাসনগোষ্ঠী এই মন্ত্র মানতে নারাজ। সে কারণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণবিরোধী শক্তি বিয়াম মিলনায়তনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিচারিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে ডিসিদের তর্জনগর্জন সেই বিদ্রোহের সুতোয় বাঁধা। সেই থেকে তাঁরা ওত পেতে আছেন। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, খাবলা মেরে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।
নির্বাচনী অপরাধের বিচার বিচারিক হাকিমদেরই করার কথা। কিন্তু গোপনে কোনো আলোচনা ছাড়াই জরুরি অবস্থায় নির্বাচনী আইনে ঠিকই ঢুকে পড়ে প্রশাসন ক্যাডার। বিচারকার্যের মাতব্বরিটা আমলাদের হাতেও থাকা চাই। এসব আমলাতন্ত্রের নখদর্পণে। সরকারি দলকে টোপ দেওয়া সহজ। সামনে আবার নির্বাচন। ডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। তাঁরা বলতেই পারেন, ওটা আমাদের দিন। দেখুন আমরা কী করি। কারণ, তখন নির্বাহী হাকিমরা ‘নির্বাচনে ঘুষ’, ‘এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির ভোট দেওয়ার’ মতো নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচার করতে পারবেন।
সত্যি বলতে কি, আমলাচালিত কোর্টকে ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হয় না। ক্যাঙারু কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর, তিনিই বিচারক। মোবাইল কোর্টেও তা-ই; বরং ক্যাঙারু কোর্টে আসামি আইনজীবীর সুবিধা পান। মোবাইল কোর্টে তা-ও লাগে না। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে ক্যাঙারু কোর্টগুলো আরও বুনো হয়ে উঠতে পারে। সিআরপিসিতে ১৯০ ধারার ৪ উপধারাটির সংযোজন তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি ছুরিকাঘাত। এটা এক অব্যাহত হুমকি। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে দেশে রাতারাতি একটি ব্যাপকভিত্তিক সমান্তরাল বিচার বিভাগের জন্ম নেবে। মুহূর্তেই দেশের আদালতপাড়ার চিত্র বদলে যাবে। খুনখারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই, টেন্ডার-সন্ত্রাস কিংবা বাড়ি দখল অপরাধ যতই জঘন্য হোক, ডিসিরা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা ইত্যাদি আমলে নিতে শুরু করবেন। এর সবচেয়ে বড় মজা ও মওকা হবে জামিন দেওয়া। মন্ত্রীদের টেলিফোনে কত দিন তাঁর জামিন প্রদানের সুখবঞ্চিত!
আমরা অবশ্যই মনে রাখব, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়া সত্ত্বেও আদালত থেকে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে-এমন আস্থা জনমনে সৃষ্টি হয়নি। সে জন্য যথা ওষুধ লাগবে। বিচার-বস্ত্র ডিসিদের হরণ করতে দেওয়া যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহ কিংবা সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তাঁদের আগ্রহের মামলাগুলো থেকে তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী তাঁরা আদালতে বেশ প্রতিকার পান। একইভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী অনেক কম প্রতিকার পান। এ অবস্থায় যখন আমরা বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছি, তখন আমরা সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট নামের দ্বৈত বিচারব্যবস্থার অবসান চাই। ১৯০ ধারার ৪ উপধারার অবিলম্বে বাতিল চাই। সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা দাবি করাকে ডিসিদের পক্ষে গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ বলে দেখা উচিত। বিচার বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল কোর্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের অবিলম্বে সুরাহা হওয়া উচিৎ। ভারত ডিসিদের দ্বারা জজিয়তি না করিয়ে যদি সুশাসন ও প্রবৃদ্ধি দুটোই দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অক্ষম হবে কেন।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।
মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮