বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহে হত্যার দায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। যে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়নি, তাদের মধ্যে চারজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে আটজনকে। একজন আগেই মারা গেছেন।
এদিকে নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। তবে নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৩১ জওয়ানকে নতুন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন মোট যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৫ জনে। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ২০০ জনের সাজা বহাল রয়েছে।
চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমতি চেয়ে আবেদন) ও আপিলের রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ (বৃহত্তর) হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
রায়ে তৎকালীর বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
দু’দিন ধরে হাইকোর্টের দেয়া এই রায়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণও এসেছে। সেখানে তৎকালীন গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কথাও বলা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধের ইতিহাসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড এক নজিরবিহীন ঘটনা। ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ বেসামরিক নাগরিককে বিডিআর বিদ্রোহীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা খুবই মর্মান্তিক, বিভীষিকাময়, নারকীয় ও ভয়ঙ্কর। এই অপরাধ সভ্য সমাজের মানুষের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের (জওয়ানদের) অপরাধ বর্বরতা ও সভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
রায়ে বলা হয়, মামলার তথ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারকে উৎখাত করার গভীর ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা ছিল। ওই ষড়যন্ত্রে অভ্যন্তরীণ ইন্ধনের পাশাপাশি বাইরের যোগসূত্রও থাকতে পারে।
রায়ে বিডিআর বিদ্রোহের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ডাল-ভাতের মতো কর্মসূচি বন্ধ, জওয়ানদের অভিযোগ থাকলে তা দ্রুত সমাধান করা, অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে পেশাদারিত্বের সম্পর্ক বজায় রাখাসহ সাত দফা সুপারিশ করেছেন আদালত। এছাড়া বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের গোয়েন্দা ইউনিট পূর্ব থেকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায় কমিটি গঠন করে তদন্ত করতেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে। আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে এবং একজন আসামি মৃত্যুবরণ করায় তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
যাবজ্জীবন
বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ জনকে হাইকোর্ট খালাস দিয়েছেন।
নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল, তাদের মধ্যে ৩১ জনকে হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া চারজনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ১৮৫ জন আসামিকে।
বিভিন্ন মেয়াদে সাজা
এ মামলার সাড়ে ৮০০ আসামির মধ্যে ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন নিম্ন আদালতের বিচারক। এঁদের মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৯ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আটজনকে দুই মামলায় আট বছর ও তিন বছর করে কারাদণ্ড, চারজনকে তিন বছর, দুজনকে ১০ ও তিন বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আদালত জানান, যাঁরা দুই মামলায় দুই মেয়াদের সাজা পেয়েছেন তাঁদের সাজা একসঙ্গে চলবে। অর্থাৎ যিনি ১০ ও তিন বছরের সাজা পেয়েছেন, তিনি সব মিলিয়ে ১০ বছর কারাভোগ করবেন। এই ২৫৬ জনের মধ্যে ২৮ জন আপিল করেননি এবং তিনজন মামলা চলাকালেই মারা গেছেন।
এর আগে ২০১৩ সালে এই মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন নিম্ন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরওয়ার কাজল সাংবাদিকদের সে সময় জানিয়েছেন, ১২৪ কার্যদিবসে মামলায় পেপারবুক উপস্থাপন করা হয়। ৩৭০ কার্যদিবসে মামলার শুনানি হয়।
গত ১৩ এপ্রিল এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন হাইকোর্ট।
এর আগে ২০১৫ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তরে পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরো ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামি দাঁড়ায় ৮৫০ জনে।
এ ছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিচার চলার সময়ে বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়।
রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু (প্রয়াত) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অন্যদিকে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা তাঁদের সাজা বাতিল চেয়ে বিভিন্ন সময়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এ জন্য মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত দুই কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। বিশেষ ব্যবস্থায় এই মামলার পেপারবুক তৈরি করা হয়।
বিচার হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে। বিচার শেষে ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।
মামলায় আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীরও দণ্ড হয়েছে। সাজা ভোগ করার সময় বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর নাম পুনর্গঠন করা হয়। নামবদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।
নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম