বছরের শুরু থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও বিচারাঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে শহর, নগর, বন্দর পেরিয়ে মহল্লার চায়ের দোকান পযর্ন্ত ছিল এ নিয়ে আলোচনা। অবশেষে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার পত্যাগের পর সে উত্তাপ প্রশমিত হয়।
বিদায়ী বছরে এক বিচারপতির দুর্নীতির অনুসন্ধান বন্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের চিঠি, বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ঐতিহাসিক রায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, এস কে সিনহার ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়া এবং প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ- সবই ছিল বিদায়ী বছরের আলোচনার শীর্ষে।
এছাড়া দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ, সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য অপসারণ এবং বিভিন্ন রায় নিয়ে সারা বছরই আলোচনায় ছিল সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন।
ভাস্কর্য ঘিরে বির্তকের সূচনা
বছরের শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এটি অপসারণ নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দেয় হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে ভাস্কর্য না সরানোর পক্ষে অবস্থান নেয় সুশীল সমাজ। ভাস্কর্য নিয়ে প্রধান বিচারপতি বরাবর পাল্টাপাল্টি স্মারকলিপি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।
পরবর্তীতে ২৭ মে সুপ্রিম কোর্টের মূল প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে ভাস্কর্যটি কোর্টের বর্ধিত (অ্যানেক্স) ভবনের সামনে স্থাপন করা হয়।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায়
বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়। পরবর্তীতে আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার সময় ‘পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখেন’ এবং ‘অসহযোগিতা করছে আইন মন্ত্রণালয়’- তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার এমন মন্তব্য সরকারের ভেতরে তীব্র আলোচনার ঝড় তোলে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনা করে বছরজুড়ে আলোচনায় থাকেন সাবেক এ প্রধান বিচারপতি।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তীব্র সমালোচনার মুখে এস কে সিনহা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ৩৯ দিনের ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ‘অসুস্থতার কারণে তিনি ছুটিতে গেছেন’। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে অসুস্থতার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই’।
আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শেষে আদালত খোলার আগের দিন গত ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা হঠাৎ এক মাসের ছুটির আবেদন করেন। ওই ছুটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইনজীবীদের মধ্যে শুরু হয় তোলপাড়। তর্ক-বিতর্ক, আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ।
তার ছুটি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগত ছুটিতে রয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। তার ছুটির সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় প্রধান বিচারপতি ছুটি নিচ্ছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একাংশের অভিযোগ, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণে ক্ষুব্ধ হয়ে সরকার প্রধান বিচারপতিকে এক মাসের ছুটি নিতে বাধ্য করেছে এবং তাকে জোর করে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। বিএনপি থেকেও একই অভিযোগ করা হয়।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাকযুদ্ধ
আগস্টে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে পড়েন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট।
সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় টেনে আনেন। রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির সমালোচনা শুরু করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে এস কে সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।
অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেতারা রায়কে স্বাগত জানান। তাদের অভিযোগ, রায়ের কারণেই প্রধান বিচারপতিকে চাপ দিয়ে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা
সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হিসেবে এস কে সিনহা শেষ অফিস করেন। অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটি নিয়ে বিদেশ যান তিনি। পরে বিদেশে বসেই পদত্যাগ করেন। তার অবর্তমানে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। সেই থেকে তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
রায় নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে সংসদে প্রস্তাব পাস
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে এখতিয়ার-বহির্ভূত (আল্ট্রা ভায়ার্স) ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, তা বাতিলের জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব পাস করে জাতীয় সংসদ।
জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাশের আগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ ১৮ মন্ত্রী-সংসদ সদস্য আদালতের রায় নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে সবাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কড়া সমালোচনা করেন। কেউ কেউ বলেন, প্রধান বিচারপতি একাধিকবার শপথ ভঙ্গ করেছেন। তার দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনেন কেউ কেউ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালতের রায়কে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এ রায় কোথা থেকে, কারা যেন তৈরি করে দিয়েছে, সেটা একটা প্রশ্ন।’
তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজেকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন; সংসদ, গণতন্ত্র—সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এর উদ্দেশ্য কী, সেটাই প্রশ্ন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের অধিকার হলো, ব্যত্যয় দেখলে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার তাদের নেই। এ রায় কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একমাত্র বিএনপি খুব উৎফুল্ল হয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছে। রায় হয়তো তারা পড়েনি। কারণ, রায়ে সামরিক শাসন অবৈধ হওয়ার বিষয় এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি তার রায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি আমিত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেই আমিত্ব এসে যায়। কাউকে পছন্দ না হলে প্রধান বিচারপতি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বিবৃতি
বিদেশ যাওয়ার সময় বাসভবনের গেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিচারপতি এস কে সিনহা। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়ার পর কোটের ডান পকেট থেকে একটি ভাজ করা কাগজ সাংবাদিকদের সামনে উঁচিয়ে ধরে তিনি বলেন, তার বক্তব্য সেখানে লেখা আছে। এরপর ডান পা বাড়িয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়েও আবার পেছনে ফিরে বলেন, ‘আমি কারো চাপে যাচ্ছি না। আমি নিজেই যাচ্ছি।’
‘আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, কিছুটা বিব্রত‘
রাত ১০টার দিকে প্রধান বিচারপতি তার বাসভবন ছেড়ে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেন, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, আবার দেশে ফিরবো। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ না।’ ‘বিচার বিভাগ যদি কলুষিত না হয় সে জন্য আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আবার ফিরে আসবো। বিচার বিভাগ যেন বিব্রত না হয়। আমি কিছুটা বিব্রত।’
এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগের কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
সর্বোচ্চ আদালত জানায়, ওই সব অভিযোগের ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ তিনি না দিতে পারায় সহকর্মীরা তার সঙ্গে এজলাসে বসতে নারাজ। ১৩ অক্টোবর বিদেশ যাওয়ার আগে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, তিনি বিব্রত, শঙ্কিত।
৪৭ বছরে বিচারাঙ্গনে প্রথম পদত্যাগ
২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া এস কে সিনহার মেয়াদ শেষ হতো ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে যান। পরে তিনি বিদেশ বসেই পদত্যাগ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ২১জন প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করলেও পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের একটির প্রধান ব্যক্তির এমন পদত্যাগ ৪৭ বছরের ইতিহাসের প্রথম ঘটনা।
নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম