ছোট পরিবারে উত্তরাধিকার আইন বাধা !

বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বিসিএস ক্যাডার (শিক্ষা), থাকেন রাজধানীর ফার্মগেটে। তার প্রথম সন্তানের জন্মের প্রায় আট বছর পর দ্বিতীয় সন্তান নিয়েছেন। প্রথমটি মেয়ে, দ্বিতীয়টি ছেলে। বিপুল বিশ্বাস বলেন, ‘প্রথম সন্তান ছেলে হলে হয়তো দ্বিতীয় সন্তানটি নিতে হতো না। আত্মীয়-স্বজনরা সবাই বলতে শুরু করে আরেকটি সন্তান নাও। ছেলে না থাকলে তো তোমার সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে না। বাধ্য হয়ে আবার সন্তান নেই। এবার ঠাকুরের দয়ায় ছেলে হয়েছে।’

বেসরকারি চাকরিজীবী মনসুর আহমেদ তিন মেয়ের বাবা। থাকেন আজিমপুরে। প্রথম সন্তান মেয়ে জন্মানোর পর টানা ১২ বছর সন্তান নেননি। এরপর পরিবারের সদস্যদের চাপে পড়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্তান নেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর সন্তান নিতে চাই না। পরিবারের চাপ এখনও আছে। একটাই কারণ, শুধু মেয়ে দিয়ে সম্পত্তি রক্ষা হবে না। আইন মেয়ের পক্ষে না।’

মিনা রাণী (ছদ্মনাম) পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীর চাপে এ পর্যন্ত চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এরপরও স্বামী সন্তান নিতে চাপ দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তিনি এখন চার কন্যাকে নিয়ে আলাদা থাকেন। আর ছেলের আশায় তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন।

বিপুল বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের চারপাশে এমন অনেক ঘটনা দেখি, যেখানে পরিবারে শুধু মেয়ে সন্তান থাকায় স্বামী ও শ্বশুর মিলে ছেলে নেবার জন্য নারীদের চাপ দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে উত্তরাধিকার আইনের কারণে ছেলে সম্পত্তি পাচ্ছে, মেয়ে পাচ্ছে না। আমি অবশ্যই এই আইনের পরিবর্তন চাই।’

বাংলাদেশে চলমান উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘উত্তরাধিকার আইন মূলত ধর্মীয় আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সামান্য পরিবর্তন হয়েছিল আইয়ুব খানের আমলে।’

তিনি বলেন, ‘হিন্দু ধর্মের কথা যদি বলি, তাহলে বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু আইন দিয়ে পরিচালিত হয়। তাদের উত্তরাধিকার হিন্দু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। পরস্পরের সঙ্গে দর্শনগত পার্থক্য থাকলেও উত্তরাধিকারের বিষয়ে পৃথক কোনও আইন নেই। নারীদের সম্পত্তির অধিকারের বিষয়ে হিন্দুধর্মে বেশ জটিলতা রয়েছে। হিন্দু ধর্মে মেয়েদের সম্পত্তিতে কোনও অধিকার নেই। তারা স্বামীর এবং বাবার অংশ পায় না। মায়ের অংশ থেকে কিছু পেয়ে থাকে। স্বামী মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি স্ত্রী জীবিত অবস্থায় ভোগ-দখল করতে পারে, কিন্তু সাধারণ নিয়মে সেই সম্পত্তি বিক্রির অধিকার স্ত্রীর থাকে না। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে, পিণ্ডদান, তীর্থযাত্রা এবং সন্তানের ভরণ পোষণের জন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন। এটি খুবই সরল ব্যাখ্যা, কিন্তু হিন্দু ধর্মে উত্তরাধিকার মূলত বেশ জটিল। দয়াভাগা এবং মিতাক্ষরা- এই দুই দর্শনে উত্তরাধিকারের ধারণাও ভিন্ন ভিন্ন রকমের। বাংলায় দয়াভাগা পদ্ধতিতে উত্তারাধিকার নির্ধারণ করা হয়।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ইসলামে উত্তরাধিকার আইনকে ফারায়েজ বলে, সেটিও বেশ জটিল। এখানে মেয়েরা বাবার সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ পায়। আর ছেলেরা বাবার সম্পত্তির আট ভাগের চার ভাগ পায়।’

তিনি বলেন, ‘সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের সমানাধিকার না থাকার কারণে বিভিন্ন মানবাধিকার ও অধিকারভিত্তিক সংস্থা অভিন্ন পারিবারিক আইন করার জন্য আন্দোলন করে আসছে। এক্ষেত্রে মোল্লা, পুরুত সবাই একই সুরে অভিন্ন পারিবারিক আইন দাবির বিরোধিতা করছে। বিধবা বিবাহ নিয়ে রাজা রামমোহন রায় যেমন প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন, এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। আমিও চাই অভিন্ন পারিবারিক আইন হোক।’

অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এখনকার সমাজে নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি স্বীকৃত। আমাদের সংবিধান সেই স্বীকৃতিও দিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীর অর্জন পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি।কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে সমতা আসেনি। রাষ্ট্রীয় কাঠামো যদি পুরুষতান্ত্রিক হয়, তাহলে সেখানে আইনে যা-ই বলা থাকুক না কেন,ফলাফল পুরুষতান্ত্রিকই হবে। নারী নেতৃত্ব থাকলেও একই ফল হবে। আমাদের সবার পুরুষের সুপ্রিমেসির এই জায়গায় আঘাত করা উচিত।’

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘মুসলিম আইনে ছেলেরা বাবার সম্পদের যে ভাগ পায়, মেয়েরা পায় তার অর্ধেক। স্ত্রী পায় স্বামীর সম্পদের মাত্র দুই আনা। যদি শুধু দুই মেয়ে থাকে, আর বাবা মেয়েদের হেবা করে দিয়ে না যান, তাহলে বাবার সম্পত্তি দাদা বা চাচাদের দিকে চলে যায়। এক্ষেত্রে মেয়েরা ১/৩ অংশ পায়। আমরা নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)’র মিটিংয়ে যখনই যাই, এটি পূর্ণ অনুমোদন দেবার জন্য বলি। সিডও-তে সুনির্দিষ্টভাবে উত্তরাধিকার আইনে নারী ও পুরুষ সমান, ছেলে ও মেয়ে এটা বলা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সিডও’র ২ ধারা ও ১৬-১ (গ) অনুমোদন করেনি। আর এ কারণেই বাংলাদেশে পারিবারিক আইনে বৈষম্য রয়ে গেছে। এদেশের কোনও সরকারই এই আইনে হাত দিতে চায় না।’ সালমা আলী বলেন, ‘মুসলিম মেয়েরা কিছু সম্পদ পেলেও হিন্দু মেয়েরা কিছুই পায় না। তাই সব সচেতন বাবা-মাই সম্পদের সমান অংশীদারিত্ব চাচ্ছে। ঢাকায় এখন কিন্তু বাবা-মায়েরা জীবিত অবস্থায় সব সন্তানকে সমানভাবে সম্পদ ভাগ দিচ্ছেন। এই প্রগ্রেসিভনেস সব বাবা মায়েরা যদি ব্যবহার করতে শুরু করেন, সরকার তখন উত্তরাধিকার আইনটি সংশোধন করতে বাধ্য হবে।’

সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘যেকোনও মানুষের জীবনে সম্পত্তিইতো আসল। স্ট্যাটাসতো সম্পত্তিকে ঘিরেই। যার ছেলে আছে সে সম্পত্তি পাবে, যার নেই সে পাবে না। যে বাবা-মায়ের দুটি মেয়ে সন্তান আছে, তারা কখনও লাইগেশন করাবে না। যতদিন ছেলে না হয়, তারা ছেলের জন্য সন্তান নিতেই থাকবেন।’

ক্যান্সার হাসপাতালের স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আফরোজা খানম রুমু বলেন, ‘আমাদের উত্তরাধিকার আইনের কারণে খানিকটা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বাধাগ্রস্ত হয়। সব বাবা-মাই ছেলে চায়।এভাবে অনেক পরিবারে অনেক বাচ্চা হয়ে যায়। মুসলিম পারিবারিক আইনে কন্যা সন্তানরা খুব বেশি বঞ্চিত হবে না। কিন্তু তারপরও বাবা-মায়েরা মেয়ে সন্তান হলে পনরায় ছেলে সন্তান চায়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলের আশায় বার বার সন্তান নিতে গিয়ে ৪/৫ জন মেয়ের জন্ম হচ্ছে। এখানে তো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ পরিষদের পরিচালক অ্যাডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলী বলেন, ‘সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এবং সমঅধিকার না থাকায়, বাবা-মায়েরা ছেলে সন্তানের দিকে ঝুঁকছেন। বাবা-মায়েরা সবসময় ছেলে সন্তানের আশায় উদগ্রীব থাকেন। ফলে বেশি সন্তান নিতে গিয়ে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। নারীর স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়।’
-বাংলাট্রিবিউন