আজ ঐতিহাসিক ও হৃদয়বিদারক ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ দিবস। ১৯৮৮ সালের এই দিনে স্বৈরাচার পতনের দাবিতে লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আট দলীয় জোট নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করতে ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের নির্দেশে পুলিশ নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তখন শেখ হাসিনার গাড়িবহর পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে পর্যন্ত পৌঁছায়। এসময় জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন নেতৃবৃন্দসহ আট দলীয় জোটের নেতারা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে ‘মৃত্যুর দুয়ার’ থেকে আদালত ভবনে সমিতির কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা করলেও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। এছাড়া, লাশ গুমের পাশাপাশি বলুয়ারদীঘি অভয়মিত্র মহাশ্মশানে বাছবিচার ছাড়াই কিছু লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও জোটের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
এ ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালে আদালতে বারের আইনজীবী শহীদুল হুদার দায়ের করা মামলাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে নগর আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আদালতের প্রবেশ পথে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে ঘটনার ৩০ বছর পূর্ণ হলেও বিচার শেষ হয়নি। সাত বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে গত বছর বিচারে কিছুটা অগ্রগতি হলেও সাক্ষীর অভাবে সেটি আবারও থমকে দাঁড়িয়েছে।
২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। ওই আদালতের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৭ সালের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিচার শেষ হয়নি। বরং ২০১৭ সালে এসে মামলাটি আবারও গতি হারিয়েছে।
আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, মামলাটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। সাক্ষীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করি। এজন্য বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য এই আদালতে মামলা আসার পর আমরা নিতে পেরেছি। তবে বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল সাক্ষী আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী ও তোফায়েল আহমেদ সাক্ষী হিসেবে আছেন। তিন মন্ত্রীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করার চেষ্টা করছি। এরপর আইনমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে কিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষ্য নেয়া যায় সেটা ঠিক করব।
পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, মামলাটি বিচারের জন্য এই আদালতে স্থানান্তরের পর গত বছরের ৩১ জানুয়ারি নিহত হাসান মুরাদের মা হাসনা বানু এবং নিহত অশোক কুমার দাশের বড় ভাই স্বপন কুমার বিশ্বাস আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের চারজন নেতা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ, সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ নিহত তিনজনের স্বজন এবং চারজন প্রত্যক্ষদর্শীসহ মোট ১০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণে সমন জারির জন্য আবেদন করা হয়। এই চার আওয়ামীলীগ নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় যোগ দিতে তার সঙ্গে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সমন পেয়ে ইতিমধ্যে গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, স্থানীয় দুটি দৈনিক পত্রিকার তৎকালীন দুই সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও অঞ্জন কুমার সেন আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত আড়াই দশকে অর্ধ শতাধিক সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। চলতি বছরের মধ্যেই মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হবে বলে আইনজীবী মেজবাহ আশা প্রকাশ করেন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ চট্টগ্রাম বারের প্রয়াত সদস্য শহীদুল হুদা বাদী হয়ে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করে সিএমএম আদালতে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সিএমপির তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার হাফিজ উদ্দিন দেওয়ান ৪৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়।
১৯৯৯ সালের ১৪ অক্টোবর সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের খান মোট আটজনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। তার দেয়া চার্জশিটে ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা সিএমপি কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা, কোতোয়ালি থানার পেট্রল ইন্সপেক্টর (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল ওরফে জে.সি. মন্ডল, কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, শাহ মো. আব্দুল্লাহ, বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়।
আদালতে দুই দফায় আলোচিত এ মামলার চার্জ গঠন (দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত আকারে) করা হয়। প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ৫ আগষ্ট এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০০ সালের ৯ মে ৮ আসামির বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/৩২৬/৩০৭/১১৪/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০০০ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর ২০০১ সালের ১৭ মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাত্র দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র একবছরে সাক্ষ্যগ্রহণ হয় ১৩ জনের।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই বছরের ২৫ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন দেওয়ানের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারিক আদালত চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আর কোন সাক্ষীকে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
এই অবস্থায় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি মামলাটি বিচারের জন্য আসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে।
ইতিমধ্যে মামলার আসামি কনস্টেবল বশির উদ্দিন, বাদী এডভোকেট শহীদুল হুদা এবং সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের খান ইতিমধ্যে মারা গেছেন।
এছাড়া, মামলার অন্যতম সাক্ষী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, আখাতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান খান কায়সারও মৃত্যুবরণ করেছেন। আর মামলার অন্যতম আসামি পুলিশ কর্মকর্তা জে.সি মণ্ডল পালিয়ে ভারতে চলে যান বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য আসামিরা জামিনে রয়েছেন।
রায়হান ওয়াজেদ/চট্টগ্রাম প্রতিনিধি