নুরে আলম: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী”। সংবিধান বাংলাদেশের জনগণকে এই অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের কোন আইন দ্বারা এই অধিকার খর্ব করা যাবে না। প্রতিনিয়ত আদালতে মানুষ আসে বিভিন্ন ধরনের দেওয়ানী ও ফৌজদারি প্রতিকার পেতে। আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আছে বলেই ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সাথে প্রতিষ্ঠানের কোন ঝামেলা হলে বলে, “ কোর্টে দেখা হবে”।
আইন বিজ্ঞানের সাধারণ নীতি হলো “ দশ জন অপরাধী ছাড়া পেলেও যেন একজন নিরপরাধ ব্যক্তির সাজা না হয়”। আইনের চোখ অন্ধ, আইন কার্যকর করতে হলে প্রমাণের প্রয়োজন। দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা প্রমাণের পরিমাণ বা মাত্রার দুইটি মানদণ্ড আছে।
১) ফৌজদারি মানদণ্ড যা যুক্তি সংগত সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ বা সন্দেহাতীত প্রমাণ (Proof Beyond reasonable doubt) বলে গণ্য হয় ;
২) দেওয়ানী মানদণ্ড যা সম্ভাব্য ভারসাম্য পূর্বক প্রমাণ ( On balance of probabilities) করা।
বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলা হচ্ছে এবং আদালতে মামলা প্রমাণ করার জন্য সাক্ষী অপরিহার্য। তাই অনেকে মিথ্যা মামলা প্রমাণ করার জন্য মিথ্যা সাক্ষীর ব্যবস্থা করে। যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যা মামলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসে তার জন্য আইনে রয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান। বাংলাদেশে অতি সুপরিচিত আইন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর সাথে সবাই কম বেশি পরিচিত। এই আইনে মামলা হলে সে মামলার জামিন দেয়ার এখতিয়ার নিম্ন আদালতের নেই। এই আইনে মিথ্যা মামলার শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। এই আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, “ যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষতি সাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোন ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করায় উক্ত ব্যক্তির সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন”। এই রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও এই আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করা বন্ধ হয়নি। এছাড়া মিথ্যা মামলা সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধি এবং দণ্ডবিধিতে শাস্তির বিধান রয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামালার শাস্তির বিধান রয়ছে। ২৫০ ধারা অনুযায়ী, “ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামীকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানীমূলক তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন”।
দণ্ডবিধির ২০৯ ধারা মতে, “মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড সহ অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবে”। আবার ২১১ ধারায় মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার শাস্তি বলা হয়েছে, “যদি কোন ব্যক্তি কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করে তবে মামলা দায়ের কারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে”।
দণ্ডবিধির ১৯১ ধারা থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্য দান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে।
দণ্ডবিধির ১৯১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা আছে, “যদি কোন ব্যক্তি সত্য কথনের জন্য হলফ বা আইনের প্রকাশ্য বিধান বলে আইনত: বাধ্য হয়ে বা কোন বিষয়ে কোন ঘোষণা করার জন্য আইনবলে বাধ্য হয়ে এরূপ কোন বিবৃতি প্রদান করে, যা মিথ্যা এবং যা সে মিথ্যা বলে জানে বা বিশ্বাস করে বা সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তা হলে উক্ত ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বলে পরিগনিত হবে”। কোন বিবৃতি মৌখিক বা অন্য কোন ভাবে দেওয়া হোক না কেন তা এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য দানের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “যদি কোন ব্যক্তি কোন বিচার বিভাগীয় মোকদ্দমায় কোন পর্যায়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি করে তাহলে সেই ব্যক্তির যে কোন বর্ণনার কারাদণ্ড-যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে- দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে, যদি অন্য কোন মামলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য মৃত্যুদণ্ড শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ১৯৪ ধারা অনুযায়ী, “ যদি কোন ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া বা উদ্ভাবন করা যার উপর ভিত্তি করে নির্দোষ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে, যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া যাবে”।
মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য একটি সামাজিক ব্যাধি যার ফলে আদালতে নিরীহ ব্যক্তি যেমন হয়রানি ও শাস্তির শিকার হয় তেমনি এই দুইটি আদালতকে ন্যায় বিচার প্রদানে বাঁধা প্রদান করে। যেহেতু মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তাই সকলের মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য পরিহার করা উচিৎ এবং সব সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিৎ।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী এবং তদন্ত কর্মকর্তাসোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটস