দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই পদত্যাগ করেছেন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বড় দুই পরিবর্তের আলোচনায় উঠে এসেছে জ্যেষ্ঠতার ক্রম না মেনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিও। এসব বিষয়ে মতামত জানতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের প্রসিকিউটর এবং ইষ্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের চেয়ারপার্সন ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজের মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি।
জ্যেষ্ঠতার ক্রম না মেনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ম বহির্ভূত বলে মনে করেন কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : জ্যেষ্ঠতার ক্রম ভেঙ্গে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ম বহির্ভূত হয়েছে বলে মনে করিনা। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিজস্ব ক্ষমতা বলে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। এখানে জ্যেষ্ঠতার ক্রম মানা বাধ্যতামূলক নয় কারণ প্রধান বিচারপতি নিয়োগ কিন্তু পদন্নোতি নয়। মনে রাখতে হবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি কারো সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শ করতে বাধ্য নন। তিনি যাকে যোগ্য মনে করেছেন তাকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির প্রাজ্ঞতা-বিজ্ঞতার ওপর জনগণের আস্থা রয়েছে। ফলে এ বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়ে জল ঘোলা করার অবকাশ নেই।
জ্যেষ্ঠতার ক্রম ভেঙ্গে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা পদত্যাগ করেছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা অত্যন্ত বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। নৈতিকতার দিক থেকে অসাধারণ এই মানুষটি একজন বিচারপতির দায়িত্ব অসাধারণভাবে পালন করেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না একজন অসাধারণ মানুষ কিংবা অসাধারণ বিচারকেরও কিন্তু পদত্যাগ করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে উনার অধিকারের জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা খর্ব করা মোটেও সমীচীন হবে না। বয়সসীমা অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বরেই তিনি অবসরে যেতেন। এখন নির্ধারিত সময়ের আগে যদি তিনি মনে করেন যে তিনি আর এই দায়িত্ব পালন করবেন না সে অধিকার উনার আছে। এক্ষেত্রে উনাকে কেউ জোর জবরদস্তি করতে পারেন না। স্বাধীন বিচার বিভাগের একজন বিচারপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবেই নিয়েছেন এক্ষেত্রে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে আনার অবকাশ নেই।
সংবিধানের ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে লেখা মতামতসমূহ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দেওয়ার নেপথ্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কতিপয় গণমাধ্যম বিষয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : প্রথমত, গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার জায়গাটি শক্ত করা প্রয়োজন। নিউজ এবং ভিউজের মধ্যে তফাৎ বুঝতে হবে। কেউ পদত্যাগ করেছেন সেটা নিউজ কিন্তু কেন পদত্যাগ করেছেন সে কারণ ব্যাখ্যা করাটা ভিউজ। কারণ না জেনে মনের মত ব্যাখ্যা দিয়ে একটা শিরোনাম ঠিক করে নিউজ প্রকাশ করা অনৈতিক। এখানে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে কেননা যে সংবাদটি প্রকাশ করা হচ্ছে কিংবা যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে সেটার পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য আছে কিনা এবং যথাযথ প্রমাণ আছে কিনা তা বিবেচনা করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, এর আগে যে পদত্যাগটি (বিচারপতি এস.কে সিনহার) নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটা কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়ে দেশত্যাগের আগ মুহুর্তে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে চিঠি ‘ছুড়ে’ দেওয়া, ‘আমি অসুস্থ নই, বাধ্য করা হয়নি, আমি একেবারে চলে যাচ্ছি না, আবার ফিরে আসবো’ টাইপের কথাগুলো তর্ক-বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু আজকের যে বিষয়টিতে (আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দেওয়া/পদত্যাগ) কথা হচ্ছে তা কিন্তু একদম আলাদা প্রেক্ষাপট। আগেও বলেছি বয়সসীমা অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বরেই তিনি অবসরে যেতেন। ফলে ব্যক্তিগত কারণে তিনি এখনই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। তিনি পদত্যাগের সময় ভিন্ন কোনো কারণও উল্লেখ করেনি। সুতরাং এই বিষয়টিকে নিয়ে গণমাধ্যমের এমন কোনো রিপোর্ট করা উচিৎ নয় যাতে করে একটি নতুন ইস্যু তৈরি করে রাজনীতির মঞ্চে বিষয়টিকে নিয়ে গিয়ে সমাধান খোঁজার অপচেষ্টা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।