বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম যে মামলাটির রায় হচ্ছে সেটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। ২০০৯ সালে মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এর মাঝে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদলতের নির্দেশে স্থগিত ছিল।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ হলো এতিমদের জন্য সহায়তা হিসেবে আসা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
ওই টাকা দিয়েছিল কুয়েতের আমির। সৌদি আরবের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যম ওই টাকা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার কাছে একটা অনুদান এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে টাকাটা ৯১ সালে জমা হয়। উদ্দেশ্য ছিল এতিমের স্বার্থে টাকাটাকে ব্যয় করা। বাংলাদেশে যারা এতিম আছে তাদের স্বার্থে টাকাটা ব্যয় হবে। প্রধানমন্ত্রীর যে ক্ষমতা আছে সে ক্ষমতা অনুসারে তিনি বাংলাদেশের সকল তহবিল সংরক্ষণ করবেন। ১৯৯৩ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামে তিনি একটা ট্রাস্ট গঠন করেন। তার ঠিকানা ছিল তার বাসভবন। ওই তহবিলের টাকা দুই ভাগ করে একভাগ তার দুই পূত্রকে সেটেলার ট্রাস্টি বানিয়ে সেখানে দিলেন।”
এ মামলার অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার পূত্র তারেক রহমান। চূড়ান্ত অভিযোগে ছয় জনের মধ্যে আরো আছেন মমিনুর রহমান, সাবেক এমপি কাজী সলিমুল হক, শরফুদ্দীন আহমেদ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী।
মি. কাজল জানান অভিযোগ প্রমাণ করতে কী যুক্তি তারা দেখিয়েছেন, “একটা আইন আছে যে দশজন এতিম থাকতে হবে। সমাজকল্যাণ দপ্তরের নিবন্ধন করতে হবে। তো সেগুলো তিনি কোনোকিছুই করেন নাই। সুতরাং আমরা বলেছি এটা রাষ্ট্রের টাকা, এতিমের স্বার্থে এসেছিল, এতিমের স্বার্থে ব্যয় না করে বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিস্বার্থে তিনি ব্যবহার করেছিলেন এবং ব্যবহার করে এই টাকাগুলি তিনি আত্মসাৎ করেছেন।”
মামলায় ২৩৬ কার্যদিবসে ৩২ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়, ২৮ কার্যদিবসে আত্মপক্ষ সমর্থন এবং ১৪ কার্যদিবস যুক্তি তর্ক শুনানী হয়।
এ সময় খালেদা জিয়াকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তার আইনজীবীরা নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন।
খালেজা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার কোনো রকম ডকুমেন্টারি কোনো রকম এটার মধ্যে হস্তক্ষেপ নাই। তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কোনো ট্রাস্টি নন, সেটেলার নয়, কোনো বেনিফিসিয়ারিও নয়। মোটামুটি যে টাকা এসেছিল দুই কোটি দশ লাখ টাকা সেটা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে কয়েকগুন বেশি হয়েছে। এই টাকা কোনো খরচ হয় নাই। এটা কোনো আত্মসাৎ হয়নাই।”
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। বিএনপি নেতা ও মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মওদুদ আহমেদ বলেন, “কতগুলো কাগজ সৃজন করেছে তারা। মূল নথি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাওয়া যায়নি। এবং তারা নিজেরাই বলেছে সেজন্য তাদের ছায়া নথি তৈরি করতে হয়েছে। এটাতো সেকেন্ডারি এভিডেন্স হিসেবেও এডমিটেড না। যে দলিলগুলো আইনগতভাবে এডমিটেড না সেই দলিলগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটা রায় দিয়ে দিতে পারে?”
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নিয়ে বরাবরই বিএনপির পক্ষে বলা হয় রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে বলা হয় দুর্নীতি হয়েছে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক মামলা করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী মনে করেন এখানে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৬টা মামলা ছিল আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছিল ১৫টি মামলা। উনি যখন ক্ষমতায় আসলেন। এসে ওনার বিরুদ্ধে যে কেইসগুলো ছিল সেগুলো তিনি স্কোয়াশ করলেনই ওনার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা ছিল সেগুলো নির্বাহী আদেশে স্কোয়াশ করা হলো। অন্যদিকে বেগম জিয়ার ৬টা মামলার যায়গায় আরো নতুন করে মামলা সংযুক্ত হলো।”
মিস চৌধুরীর মতে, “যেগুলি আমরা দেখছি দৃশ্যমান এর পেছনে আসল জিনিসটা হলো ক্ষমতার লড়াই।”
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা চলার এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার ওই আবেদন উচ্চ আদালত মঞ্জুর করেননি। খালেদা জিয়াই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা প্রথম কোনো ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায় হলো।
(