জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৫ বছর সাজা হয়েছে। একই মামলায় দলটির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সাজা নিয়ে খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে আছেন। দুই শীর্ষ নেতা দুর্নীতিবাজ প্রমাণ হওয়ায় বিএনপির অবস্থা এখন টালমাটাল। দলটির রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত নেতাকর্মীরা।
জাতীয় নির্বাচনও আসন্ন। এমতাবস্থায় খালেদা জিয়ার কারাবাস কী দীর্ঘ হবে নাকি জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে আসতে পারবেন, এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। দুর্নীতি মামলায় সাজার খড়গ মাথায় নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, এ নিয়েও চলটির নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন। তবে এ বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে উচ্চ আদালতের রায়ের ওপর। এমনটি মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায় পর্যবেক্ষণ করে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিকে বিএনপি নেত্রীর সাজার রায়ে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা প্রতিটি বাংলাদেশির জন্য অসম্মানের বলেও মন্তব্য করেন তুরিন আফরোজ। যুক্তরাজ্যের কাছে আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। একুশে টেলিভিশনের পক্ষে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী আদনান।
রায়ে খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এখন কী তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনের কারণে কারো যদি অন্তত দুই বছরের সাজা হয়, তাহলে পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। বেগম জিয়া যে মামলায় কারাগারে গেলেন নিঃসন্দেহে তিনি নৈতিক স্খলনের দোষে দুষ্ট, এতে সন্দেহ নেই। তবে, তিনি সবেমাত্র নিম্ন আদালত থেকে একটি রায় পেয়েছেন এবং রায়ের দণ্ড কার্যকর শুরু হয়েছে মাত্র। তিনি এখন আপিল করবেন। এখন দেখার বিষয় শুনানির পর উচ্চ আদালত কী বলে।
এমন হতে পারে আপিল গ্রহণের পর উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করে দিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি মুক্তি পেলেন। আপিলের রায় না আসার আগেই যদি নির্বাচন চলে আসে, সেক্ষেত্রে বিএনপি নেত্রী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেতেও পারেন। এর কারণ, আপিলের রায়ে যতক্ষণ পর্যন্ত তার অপরাধ প্রমাণিত হবে না, ততক্ষণ তার দণ্ড কার্যকর হবে না। এদিকে আইনে বলা আছে, সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় যদি রায় হয় এবং সেই রায়ে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ শুন্য হয়ে যাবে। আর যদি তিনি ওই মামলা থেকে খালাস পান বা দুই বছরের কম কারাদণ্ড পান, তাহলে সংসদ সদস্য থেকে যাবেন।
আপিল খারিজ হলে তিনি কি রিভিউ’র সুযোগ পাবেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: হ্যাঁ, তিনি আপিল রিভিউ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন আমাদের দেখার বিষয় হাইকোর্ট কী বলছেন। এমনও হতে পারে যদি দণ্ড কার্যকর থাকে, তবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদও কারাগারে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী এমন কোনো সম্ভাবনা আছে?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: অবশ্যই, এমন হতে পারে যে, খালেদা জিয়া জেলে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। এরইমধ্যে আরও কয়েকটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাই খালেদা জিয়া জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত যদি নির্বাচন হয়, সেক্ষেত্রে এই রায় উচ্চ আদালতে স্থগিত হলে খালেদা জিয়া কারাগারে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যেহেতু উচ্চ আদালত এখনও কিছুই বলেননি সেহেতু মামলাটি এখনও শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আমাদেরকে এখন দেখতে হবে উচ্চ আদালত বিশেষ আদালতের রায়ের উপর কী নির্দেশনা দিচ্ছেন। এরপরই খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি খোলাসা হবে।
খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনো পর্যবেক্ষণ বা নির্দেশনা রায়ে থাকতে পারে কি না?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: না, নির্বাচনের ব্যাপারে উচ্চ আদালতের রায়ে কিছু লিখা থাকার কথা না। কারণ, এ রায়ের বিবেচ্য বিষয় নির্বাচন নয়। এ রায়ের বিবেচ্য বিষয় অর্থ আত্মসাৎ। সে কারণে তিনি যখন উচ্চ আদালতে যাবেন তখন দণ্ড কার্যকর হচ্ছে কি হচ্ছে না বা কী দণ্ড হবে তা আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি পারবেন না, রায় বিবেচনা করে সেই সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন তখন আদালতের রায় পর্যালোচনা করে জানাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ তার আছে কি নেই।
লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনাকে কিভাবে দেখছেন?
ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ: লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনা খুবই ন্যাক্কারজনক এবং নিন্দনীয়। প্রত্যেক বাংলাদেশির জন্য এটি অসম্মানের। যখন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নিয়ে নাক গলায় তখন আমরা প্রতিবাদ করি, ক্ষোভ জানাই। কেন তারা নাক গলাবে তা নিয়ে প্রতিবাদ করি। কিন্তু আদালতের রায় নিয়ে বিদেশের মাটিতে যা ঘটলো তা কি মানুষের কাজ? রায় আমার পক্ষে যেতে হবে, না গেলে যা ইচ্ছা তা করব- এটা তো কোনো সভ্য মানুষের চিন্তা বা আচরণ হতে পারে না।
ওই হামলার ঘটনায় বাংলাদেশের কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? এতে যুক্তরাজ্য সরকার দায় এড়াতে পারে কি না?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আন্তর্জাতিক আইনে আমাদের কূটনৈতিক সুরক্ষা পাওয়ার যে অধিকার রয়েছে তা ব্যহত হয়েছে। আমাদের হাইকমিশন বা দূতাবাসগুলো পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী। আমরা এখন দেখলাম হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকার সেই সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় তারা এড়াতে পারে না। আমি মনে করি যুক্তরাজ্য সরকার কঠোর তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। ‘Chorzow Factory Case’ মামলায় আদালতের স্পষ্ট নির্দেশনা হলো- কেউ যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে ক্ষতিপূরণ পাওয়া তার একটি সাধারণ অধিকার। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ তাদের দূতাবাসে যে ভাংচুর হয়েছে, সেজন্য যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে ক্ষতিপূরন চাওয়ার অধিকার রাখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশ সরকার তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে।