নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম উপাদান হলো ইট। ইট ছাড়া রাস্তাঘাট, ইমারতের অবকাঠামো করা দুস্কর। সেই ইটেও চলছে কারসাজি বা ফাঁকিবাজি। ইটের আকার বা সাইজ কারসাজি করে ছোট করা হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তাগিদে নয়, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভে ইটের আকার ছোট করা হচ্ছে। এতে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঠকছেন ক্রেতা। ইটের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় ১ থেকে ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা।
সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) অভিযানে এমন প্রতারণা ধরা পড়েছে। এ অপরাধের কারণে ইতিমধ্যে শতাধিক ইটভাটা মালিককে জরিমানাও করা হয়েছে। ছোট ইট উৎপাদনে খরচ কম। শ্রমিকের ব্যয়ও কম হয়। অল্প জ্বালানির ব্যবহার ও অল্প মাটিতে অধিকসংখ্যক ইট তৈরি করা যায়। তাই বেশি মুনাফার আশায় সূক্ষ্ণ কৌশলে এসব করছেন ইটভাটা মালিকরা। সঠিক মাপের ১০ হাজার ইটের খরচে ১২ হাজার ৫০০ ইট তৈরি করছেন মালিকরা।
নির্মাণ সংস্থাগুলো বলছে, ইটের আকার ছোট করে ফেলায় এখন প্রতি লাখে তাদের আরও ২৫ হাজার ইট বেশি লাগছে। পাশাপাশি বালু ও সিমেন্টের খরচ বেশি হচ্ছে। এতে ব্যয় আরও বাড়ছে। তবে ইটভাটা মালিকরা এসব অস্বীকার করছেন। তাদের দাবি, অঞ্চলভেদে মাটির গুণাগুণের কারণে ইট চুপসে ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেক ইটভাটা মালিক দাবি করছেন, তারা সঠিক মাপটা জানেন না।
ওজন ও পরিমাপে কারচুপি রোধে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ইটের নির্দিষ্ট একটি পরিমাপ রয়েছে। এই পরিমাপ অনুসারে একটি ইটের আকার দৈর্ঘ্যে ২৪ সেন্টিমিটার বা ৯ দশমিক ৪৫ ইঞ্চি, প্রস্থ ১১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা ৪ দশমিক ৫৩ ইঞ্চি ও উচ্চতা ৭ সেন্টিমিটার বা ২ দশমিক ৭৬ ইঞ্চি হওয়ার কথা। যদিও ক্রেতার প্রচলিত ধারণা, একটি ইট দৈর্ঘ্যে ১০ ইঞ্চি, প্রস্থে ৫ ইঞ্চি ও উচ্চতা তিন ইঞ্চি। স্থপতিদের হিসাব অনুযায়ী নির্মাণের ক্ষেত্রে ইটের পাশে বালু, সিমেন্টসহ দেয়ালে এমন আকার হয়। এখন ওই দশ ইঞ্চি তো দূরের কথা, বিএসটিআইর পরিমাপ অনুযায়ী ইট তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান পরিমাপ সনদ নিয়েও ছোট ইট তৈরি করছে। বিএসটিআইর মান সনদ নিয়ে সে অনুযায়ী ইট তৈরি করছে মাত্র ১০ শতাংশ ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটার মালিক সনদ নেয়নি এবং মানও ঠিক নেই। এভাবে চলছে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা। এ বিষয়ে মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই সনদ দেওয়ার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার ছাড়পত্র দিচ্ছে। তারাও এ বিষয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয় প্রশাসনও এমন প্রতারণার বিষয়ে কোনো তদারকি করেনি। এর ফলে দিনের পর দিন ক্রেতা ঠকছেন।
পণ্যে ভেজাল, ওজনে কারচুপি, বিক্রয়োত্তর সেবা না পাওয়া, গ্যারান্টি বা ওয়ারেন্টির নামে ধোঁকাবাজি, মোড়কীকরণে সূক্ষ্ণ কারচুপি নিত্যনৈমিত্তিক ও একটি অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্রুত এবং এককালীন মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতাই বেশি হচ্ছে। এ কারণে ক্রেতার চোখ ফাঁকি দিয়েই এভাবে ইট বিক্রি করে আসছেন ব্যবসায়ীরা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, মাটির গুণাগুণের কারণে ইটের আকার ছোট হওয়ার কথা নয়। পোড়ানোর পরে ইটের আকার কেমন হবে সে অনুযায়ী ফর্মা তৈরি করা উচিত। যাতে বিএসটিআইর মান অনুযায়ী হয়। তিনি আরও বলেন, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় আইনগুলো শক্তিশালী করা উচিত। একই সঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণকারী ও আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। ডিএনসিআরপির অভিযানে কিছুটা সজাগ হয়েছেন ইটভাটা মালিকরা। আগামীতে এ বিষয়ে বিএসটিআইর আরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
ডিএনসিআরপির তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে ইটভাটার অভিযানে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে ছোট ইট পাওয়া গেছে। এসব ইটের দৈর্ঘ্য ছিল ২০ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ছিল ১০ থেকে ১১ সেন্টিমিটার। আর উচ্চতায় ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার। এই কম আয়তনের ফলে ক্রেতারা ১০০ ইটে প্রায় ২৫টি পর্যন্ত কম পেয়েছেন। অভিযানে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ইট উৎপাদন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য না দেওয়া এবং ওজন ও পরিমাপে কারচুপির প্রমাণ পেয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী এসব অপরাধের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, বেশিরভাগ ইটভাটা ছোট ইট তৈরি করছে। এ কারণে সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি ইটভাটা মালিক সমিতি অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা ত্রুটি সংশোধনের জন্য এক মাস সময় চেয়েছেন। আগে তৈরি করা ছোট ইট কম দামে বিক্রি করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বেঁধে দেওয়া এ সময় শেষ হয়েছে। এখন ত্রুটি সংশোধন হয়েছে কি-না, তা যাচাই করে দেখতে আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জানা যায়, গত ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে এ অভিযান শুরু করে অধিদপ্তর। মাসব্যাপী এ অভিযানে এসব এলাকার নামিদামি বিভিন্ন ইটভাটায় প্রায় ৮৫ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত জানুয়ারি মাসে এই অভিযানের পরে ইটভাটা মালিকরা ত্রুটি সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দেন।
ইটভাটা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইট উৎপাদক মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবু বক্কর বলেন, ২০০৯ সালে বিএসটিআই মান ও আকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। অনেক ইটভাটা মালিক এটা জানেন না। বিএসটিআই সেভাবে প্রচার করে ইটভাটা মালিকদের অবহিত করেনি। সম্প্রতি তাদের সমিতি থেকে সব ইটভাটা মালিককে সঠিক মাপ ও সে অনুযায়ী উৎপাদনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিএসটিআইর সঙ্গে বৈঠক করার জন্য সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। সংস্থাটি সময় দিলে ইটভাটা মালিকরা বৈঠক করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। আবু বক্কর আরও বলেন, ইটভাটায় তৈরি ছোট ইট কম দামে এখন বিক্রি সম্ভব হবে না। তৈরি সব ইট একসঙ্গে বিক্রিও সম্ভব না। তাছাড়া এবার আকার সংশোধন করতে হলে মৌসুমের এ সময়ে চুলা ভাঙতে হবে। সে ক্ষেত্রে চলতি বছরে ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। আগামী বছর থেকে সঠিক মাপে ইট তৈরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
(মিরাজ শামস/সমকাল)