ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ :
বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে মাতৃভাষাতেই আদালতের রায় লেখা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা জার্মানি, জাপান অথবা চীনের কথা বলতে পারি। এসব দেশের আদালত নিজেদের মাতৃভাষাতেই রায় লিখে থাকেন। তবে যেসব রায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র মনে করে যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো তারা অন্য ভাষায় অনুবাদ করে থাকে। তাহলে একই পদ্ধতি বাংলাদেশে অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। এসব রায় ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন কী? তবে বাকি যে ৫ শতাংশ রায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে, শুধু সেসব রায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে মায়ের ভাষায় আমরা আমাদের আদালতের রায়ও পাব, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো তাদের আন্তর্জাতিক আমেজও হারাবে না
‘আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী
আরাকানের রাজসভার মণিময় অলংকার, বরেন্দ্রভূমির
বাউলের উদাস আহ্বান, মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম
আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।’
—মুনীর চৌধুরী
বাংলা আমার মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমি কথা বলি, গান গাই, হাসি, কাঁদি, মনের ভাব প্রকাশ করি। আমি যে দেশে বাস করি তার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী সংবিধান হলো প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। মহামান্য আদালত যদি প্রজাতন্ত্রের একটি বিভাগ হয়ে থাকে, তবে আদালতের রায় কেন বাংলায় লেখা হবে না? মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে অসুবিধাটা কোথায়?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। পৃথিবীতে আর কোনো জাতিকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে হয়নি। অমর সাহিত্যবিশারদ মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন, ‘মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই সে মানুষ নহে।’ তাহলে আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন কেন নিশ্চিত করতে পারছি না? আমরা কি তবে আমাদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে অমানুষে পরিণত হয়ে উঠছি?
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশের স্থপতি সেদিনের তরুণ যুবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত্তকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক’ (ভাষাসৈনিক গাজীউল হক)। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি—সুদীর্ঘ এক হাজার ৬৩৫ দিন পরও এই ঘোষণা অমর হয়ে ওঠে বাঙালির ভাষা আন্দোলনে আত্মদানের মাধ্যমে। বাঙালির ২১ ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। পূর্ব পাকিস্তানকে ছুড়ে ফেলে বাঙালি আজ স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে। তবে আমার বাংলাদেশের আইন ও আদালতের রায়ের ভাষা এখনো ইংরেজি ভাষার নিগড়ে আবদ্ধ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি—সুদীর্ঘ ১৯ বছর। বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সেই বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা দেন অখণ্ড পাকিস্তানের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্ত যখন আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেলাম এক মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে, এক নতুন সংবিধান পেলাম স্বাধীন রাষ্ট্রের, তখন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গৃহীত সংবিধানে কি একই রকম দ্যোতনা দেখতে পেয়েছি? উত্তর—নিঃসন্দেহে ‘হ্যাঁ’। বাংলা ভাষায় রচিত পৃথিবীর একমাত্র সংবিধান হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩-এ লেখা হলো, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু মহামান্য আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখা হয় না।
মায়ের ভাষায় আদালয়ের রায় লিখতে হবে। তার কারণ—
প্রথমত, বিচারের রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। তারাই যদি আদালতের রায় সঠিকভাবে বুঝতে না পারে তবে রায় লেখার অর্থ কী? ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না এটা বুঝবে কী করে মানুষ? তাই মহামান্য আদালতের রায়গুলো বাংলায় লিখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘অনেকের ধারণা, বাংলায় লেখা হলে আমাদের রায় কেউ পড়বে না। আমাদের রায় পড়ার জন্য যেন সারা বিশ্ব রাত জেগে বসে আছে! যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ জড়িত ও বাণিজ্যের সম্পর্ক, সেসব দেশের বেশ কিছু লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের ল জার্নাল বা বই নেই বললেই চলে।’
তৃতীয়ত, আমাদের আদালতে বিচারপ্রার্থীরা বাঙালি, আইনজীবীরা বাঙালি, মহামান্য বিচারপতিরাও বাঙালি, কিন্তু আদালতের রায়ের ভাষা বাংলা নয়।
চতুর্থত, অন্য ভাষায় আইনচর্চার ফলে আমরা আইনশাস্ত্রে স্বাভাবিক সহজতা লাভ করতে পারিনি, পারিনি তেমন কোনো মৌলিক অবদান রাখতেও। বাংলায় ভালো মানের আইনের বই পাওয়া দুষ্কর। আবার ইংরেজিতে আইনের ওপর লেখা দেশি লেখকের বইয়ের সংখ্যা অপ্রতুল। তাহলে আমাদের আইনের শিক্ষার্থীদের আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অন্ধ বানিয়ে রেখেছি। বাংলা ভাষায় আইনের ওপর গবেষণাপত্র আমরা হেসে উপেক্ষা করে উড়িয়ে দিই। বড় বড় চোখ করে এই আমাদের মতো আইনের শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের উপহাস করে বলি, ‘ইংরেজি জানো না, তবে আইন পড়তে এসেছ কেন?’ কী করছি আমরা? কোমলমতি আইনের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বলা রোবটে পরিণত করতে পারলেই ভাবছি আমাদের শিক্ষকজীবন সার্থক। এটা অন্যায়। আদালতের ভাষা বাংলা হলে শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় আইন শিক্ষাদানের মাধ্যমে আমরা তাদের জ্ঞানের বিস্তার সাধন করতে পারব। আর তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে গেলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়। যে ভাষা দেশের সর্বত্র সমীরিত, যাহাতে সমস্ত জাতির মানসিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিষ্পন্ন হইতেছে, শিক্ষাকে সেই ভাষার মধ্যে মিশ্রিত করিলে তবে সমস্ত জাতির রক্তকে বিশুদ্ধ করিতে পারে, সমস্ত জাতির জীবনক্রিয়ার সহিত তাহার যোগসাধন হয়।’
পঞ্চমত, বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে মাতৃভাষাতেই আদালতের রায় লেখা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা জার্মানি, জাপান অথবা চীনের কথা বলতে পারি। এসব দেশের আদালত নিজেদের মাতৃভাষাতেই রায় লিখে থাকেন। তবে যেসব রায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র মনে করে যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো তারা অন্য ভাষায় অনুবাদ করে থাকে। তাহলে একই পদ্ধতি বাংলাদেশে অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। এসব রায় ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন কী? তবে বাকি যে ৫ শতাংশ রায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে, শুধু সেসব রায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে মায়ের ভাষায় আমরা আমাদের আদালতের রায়ও পাব, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো তাদের আন্তর্জাতিক আমেজও হারাবে না।
ষষ্ঠত, এমন কিছু মামলা রয়েছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব মামলার রায় বাংলাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, যাতে দেশের সব মানুষ তা বুঝতে পারে অতি সহজেই। এ বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনী মামলার হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে মহামান্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল লিখেছেন, ‘স্বভাবতই সংবিধানসংক্রান্ত মামলা জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব মামলার রায় থেকে জনগণ তাদের পবিত্র সংবিধানকে আরো বেশি গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে পারে। পূর্বতন চারটি সংবিধান সংশোধন মামলাই বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে উল্লিখিত ঐতিহাসিক মামলাগুলো ভবিষ্যৎ সব সাংবিধানিক সংকটে আমাদের পথ দেখাবে। এ ধরনের মামলা জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। সে কারণে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর রায় পড়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের অসীম আগ্রহ। সে প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, এই ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মামলাগুলো ও যেসব মামলায় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় সেসব মামলার রায় অবশ্যই বাংলায় প্রদান করা ন্যায়সংগত।’
১৯৯৮ সালের ১ মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দেশের আদালতে… দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সে তো এক লজ্জাকর ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’
দেশের আদালতে দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হতে হবে। মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে হবে। ইংরেজি ভাষার নিগড় ভেঙে বাংলা ভাষাকে মুক্তি দিতে হবে, কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো আজ তাঁর সন্তানরাও দিগ্বিদিক হুংকারে ঘোষণা করুক—‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অধ্যাপক , আইন বিভাগ , ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি