ড. বদরুল হাসান কচি
বহু রক্ত আর ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন এই দেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা সংবিধানেই স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দেয়া আছে। সংবিধানের প্রথম ভাগের অনুচ্ছেদ- ৩ এ বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। তাই সাংবিধানিক বিধান মোতাবেক, আদালতের ভাষাও বাংলা। অথচ, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো দেখতে পাই, দেশের সকল আদালতে বিচার কাজে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। যার ফলে, উচ্চ আদালতে আসা বেশীরভাগ বিচারপ্রার্থী মামলার ইংরেজি নথিপত্র ও রায় সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি, বিচারপ্রার্থী কেউ কেউ আদালতের রায়ের প্রাথমিক আদেশটি তার নিযুক্ত আইনজীবীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে পরে অপর আরেকজন আইনজীবীর শরণাপন্ন হন; আদেশে কি বলা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে। বক্তব্যের এই জায়গায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখার দুটো লাইন মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আইন ও বিচার তো দেশের লোকের জন্য। বিদেশীদের সুবিধা-অসুবিধা গৌণ ব্যাপার। দেশের রায় বাংলায় লিখতে হবে, যাতে নিরক্ষরও শুনলে কিছু বুঝতে পারে। বিদেশীদের অসুবিধা এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।’ (এখানে একটু উল্লেখ করা দরকার, নতুবা অনেকে মনে করবেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তো প্রধান বিচারপতি ছিলেন তিনি তাহলে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে ব্যাপকভাবে উদ্যোগ নিলেন না কেন? -তিনি ১৯৯৫ সালে মাত্র কয়েক মাসের জন্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকিত করেন এবং তিনি সে সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বাংলায় রায় প্রদান করতে অনুরোধ করলেও সফল হতে পারেননি। -বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের এক লেখা থেকে এ তথ্য জানা গেছে)
সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত এক সরকারী আদেশ জারী হয়। সেই আদেশের প্রথম অংশেই বলা ছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষার নথিপত্র দেখা যাচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।…বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্তা ব্যক্তিগণ সতর্কতার সাথে এ আদেশ কার্যকরী করবেন এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।’ এরপরও দেশের সব আদালতে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি।
আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও ব্যাপক প্রচলন। বাংলা আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে; এমনকি শহীদ দিবসকে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রে দিবসটি পালিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং মাতৃভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সেসব দেশগুলো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এটা আমাদের জন্য বিশাল গৌরবের বিষয়। অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় কিংবা সমাজ জীবনে বাংলা এখনো তার উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। যার প্রেক্ষিতে দেশের অফিস আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং সাংবিধানিক বিধানবলী পূর্ণরূপে কার্যকর করার জন্য ১৯৮৭ সালে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ প্রণয়ন করা হয়। আইন হয়েছে ঠিক কিন্তু তা বাস্তবায়নে তেমন পদক্ষেপ দেখা যায় না।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাষ্ট্রের অপর দুইটি অঙ্গ, অর্থাৎ- শাসন বিভাগ কিংবা নির্বাহী বিভাগে কোথাও কোন প্রতিষ্ঠানে যদি বাংলা ব্যবহার না হয়ে ইংরেজি ব্যবহার হতো সেক্ষেত্রে দেশের উচ্চ আদালত সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের আদেশ দিতেন। কারণ, আদালতই হচ্ছে জনগণের শেষ আশ্রয়। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই বিচার বিভাগ তখন ঠিকই এগিয়ে আসতেন।
তবে উচ্চ আদালতে সব বিচারকেই যে একই চিন্তা-চেতনা ধারণ করেন তা কিন্তু নয়। আমরা দেখেছি, বর্তমানে দুইজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে রীতিমত নজীর সৃষ্টি করেছেন। তারা দুইজনেই হাইকোর্টে কর্মরত আছেন। একজন হলেন- বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন এবং অপরজন মোঃ আশরাফুল কামাল। দুইজনেই হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চে জ্যৈষ্ঠ বিচারপতির সঙ্গে বিচারকাজে নিয়োজিত থাকলেও নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে থাকেন। বিচারপতি শেখ জাকির হোসেন তার আট বছরের কর্মজীবনে কখনোই বাংলা ভাষার বাইরে গিয়ে রায় বা আদেশ লিখেননি। তার রায় ও আদেশের সংখ্যা ইতোমধ্যে সাত হাজার ছাড়িয়েছে, যা এককভাবে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজীরবিহীন। অন্যদিকে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালও গত ১৭ আগস্ট থেকে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে যাচ্ছেন, যার সংখ্যাও ৫০ টিরও অধিক।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ৯০ দশক থেকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি (প্রয়াত) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন; কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল’ রিপোর্টার্স ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্যানুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায় বাংলায় দিয়েছেন।
বিভিন্ন লেখা পাঠ থেকে উদ্ধার করা যায়- ঠিক কি কারণে উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্য রয়েছে- বিচারপতিদের বাংলায় রায় লেখার মানসিকতার অভাব; বিচারকদের বক্তব্য (ডিকটেশন) বাংলায় সহজে ও দ্রুত লিখতে না পারা; বাংলা ভাষায় আইনের তেমন প্রতিশব্দ না থাকা; আইনের সব ভাষ্য ইংরেজিতে হওয়া এবং বহির্বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো ইংরেজিতে হওয়ায় তা নজির হিসেবে ব্যবহারে বাংলা অনুবাদে সময়ক্ষেপণ; অনেক আইনজীবীদের বাংলায় আবেদন করা ও শুনানিতে অনীহাও রয়েছে।
অথচ বিশ্বের বুকে ‘বাংলাদেশ’ই একমাত্র দেশ যা কিনা দেশের ভাষার নামে দেশ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা কিনা রক্ত দিয়ে মায়ের মুখে ভাষা ‘বাংলা’কে অর্জন করেছে। এ দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। অথচ সে দেশের উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে অনীহা আর নানান রকম আপত্তি। আমরা এ ভাষার মাসেই দেশে নতুন প্রধান বিচারপতি পেয়েছি এবং আইনজীবীদের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের মুখেই বলেছেন ফেব্রুয়ারি তার সৌভাগ্যের মাস। কারণ, তিনি ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। দুই বছর পর ২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ হাইকোর্টে স্থায়ী হয়। এর ঠিক আট বছর পর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। সর্বশেষ এ ফেব্রুয়ারি মাসেই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি নিয়োগ পেলেন। তার অবসরে যেতেও কয়েক বছর হাতে সময় রয়েছে। তাই এখন থেকেই তিনি যদি উচ্চ আদালতে বাংলা চর্চার উদ্যোগ হাতে নেন তাহলে মেয়াদ শেষ নাগাদ পুরোপুরিভাবে সফল হতে পারবেন এবং সেই সাথে তিনি ইতিহাসে একটি অনন্য নজীর সৃষ্টিকারীও হবেন।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।