আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি। পিলখানায় ভয়াবহ বিডিআর (তৎকালীন) বিদ্রোহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর। ২০০৯ সালের এই দিনে তৎকালীন বিডিআরের কিছু বিপথগামী জওয়ান বিদ্রোহের নামে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ড চালান। টানা এক দিন এক রাত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনে সরকার। এ সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীরা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। নিহতদের লাশ গুম করতে পিলখানার ভেতরে গণকবরও দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে বাহিনীর নিজস্ব আইনে দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। আর পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় গত বছর ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা। বিচারিক আদালতে এই মামলায় রায় এসেছিল ২০১৩ সালে। আর অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলার বিচার চলছে ধীরগতিতে।
বিদ্রোহের ঘটনায় স্বজনহারাদের কান্না থামেনি আজও। দুঃসহ সেই দিনের স্মৃতি তাড়া করে ফেরে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা কর্মকর্তা ও স্বজনদের। সেই দুঃসময় কাটিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)। সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে বাহিনীটি।
বিদ্রোহের পর বিডিআর আইন, নাম, পোশাক, পতাকা ও মনোগ্রামসহ অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনা হয়। তবে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলার বিচার কার্যক্রমে গতি নেই। মাসে এক-দুদিন করে চলে কার্যক্রম। ৬৫৪ সাক্ষীর মধ্যে ৯ বছরে মাত্র ৫০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পেরেছেন বিচারক। আগামী ১৮ মার্চ এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে। চলতি মাসের ১৮ তারিখে সাক্ষ্যগ্রহণের কথা থাকলেও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লা বকশিবাজারের অস্থায়ী এজলাসে না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
পিলখানার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, মাসে দুই দিন করে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বর্তমানে ৫০ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণে ধীরগতি থাকলেও চলতি বছরই এই মামলার বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, হত্যামামলার বিচার দ্রুত শেষ হয়েছে। অথচ এই মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। দির্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় দায়রা জজ আদালত ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ১৫৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এর পর গত ২৬ নভেম্বর এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল নিষ্পত্তি করে ১৩৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৮৫ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ২২৮ আসামিকে ৩ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে আপিল বিভাগে আপিল করবে বলে জানিয়েছে আসামিপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষও পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবে।
আদালতে উঠে আসে লোমহর্ষক তথ্য
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকি। একইসঙ্গে সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে বিডিআর হত্যা মামলার রায়ে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার সময় উচ্চ আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন সেদিনের লোমহর্ষক সব তথ্য। তারা বলেন, সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করাই ঘটনার শেষ নয়, লাশের চেহারা পাল্টে দিতে মৃতদেহে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে লাশ বিকৃতির মতো বিভৎসতা ছিল। এমনকি আসামিরা সেনা কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে পুরুষ ও নারীদের লাশ একসঙ্গে মাটি চাপা দেয়।
২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায় দেওয়া শুরু করেন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন— বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
অপরাধীদের নৃশংসতার কথা তুলে ধরে আদালত বলেন, ‘নারী, শিশুসহ গৃহকর্মীকেও পাশবিকতা থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। অভিযুক্তরা বিদ্রোহের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নির্যাতন, বাড়ি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিন ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি, লাশ গুম, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধকর্ম সংগঠিত করে।’
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কিছু লাশ ম্যানহোলের ভেতরে, কিছু লাশ স্যুয়ারেজ লাইনের ভেতর ও অধিকাংশ লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে বিডিআর হাসপাতালের মরচুয়ারিতে ও এমটি গ্যারেজের পাশে গণকবর দেওয়া হয়। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেই বিদ্রোহীরা ক্ষান্ত হয়নি। বরং লাশের চেহারা পাল্টে দেওয়ার জন্য মৃতদেহে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে লাশের চেহারা বিকৃত করে। আসামিরা সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের প্রতি কোনও প্রকার শ্রদ্ধা না দেখিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন না করে পুরুষ ও নারীদের লাশ অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় একসঙ্গে মাটি চাপা দেয়। এমনকি গণকবরের ওপর ইট, কাঠ, গাছপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে ক্যামোফ্লেজ সৃষ্টি করে, যাতে সেখানে গণকবর আছে তা বোঝা না যায়।’
আদালত ২০০৯ সালের এই ট্র্যাজেডির মূল লক্ষ্য বলতে গিয়ে রায় পড়ার সময় উল্লেখ করেন, এর উদ্দেশ্য ছিল সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে কোনও মূল্যে দাবি আদায় করা, বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা।
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে এটি ঘটানো হয়েছিল উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নবনির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিপতিত করা, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছিল।’
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের তথ্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই সময়ের গোয়েন্দাদের নিষ্ক্রিয়তা তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করা উচিত বলে সুপারিশ করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, ‘কোনও রকম ষড়যন্ত্র ছাড়া এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে না।’
বিচার হয়েছে দুইভাবে
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে দু’ভাবে বিচার করা হয়। একটি হলো বাহিনীর নিজস্ব আইনে, অন্যটি ফৌজদারি আইনে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোকের সাজা হয় অধিনায়কদের সামারি ট্রায়ালে। এতে মোট ১১ হাজার ২৬৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ আদালত গঠন করে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এসব মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। তাদের প্রত্যেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত ১১৫ জন চাকরি ফিরে পেয়েছেন।
বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এই দিনটি শাহাদতবার্ষিকী হিসেবে পালন করবে। এদিন বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর কোরআন খতম এবং বিজিবির সব মসজিদে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করা হবে। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবির মহাপরিচালক স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
আগামীকাল সোমবার বাদ আসর পিলখানায় বীরউত্তম ফজলুর রহমান মিলনায়তনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এতে উপস্থিত থাকবেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআরের জওয়ানরা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেদিন পিলখানার এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের ৫৭টি ইউনিটে। টানা এক দিন এক রাত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আসে।