ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:
সময়টা ছিল ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস। তখনও আমি প্রসিকিউটর হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যোগদান করিনি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক হিসেবে কাজ করে চলেছি কখন ও ঢাকায়, কখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমাদের নির্মূল কমিটির কর্মীদের জন্য অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহন করেছে , শহীদ পরিবারের যারা সদস্য রয়েছে কিংবা বীরাঙ্গনা রয়েছে তাদের সাথে সরাসরি ভাবে কাজ করার একটি জায়গা তৈরি করা ।কাজটি আসলে যতটা সহজ ভাবা হয় আদতে কাজটি ততটাই কঠিন এবং কাজটি শুরু করার পরে এই বিষয়টি আরও সম্যক ভাবে উপলব্ধি করা যায়। একেকটি শহীদ পরিবারের সাথে যখন যোগাযোগ হত কিংবা কোন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলতাম তখন একাত্তরের বাসবতা ও ভয়াবহতা মূর্তমান হয়ে উঠত। নির্মূল কমিটিতে কাজ করা আমার তার বহু আগে তবে ২০১২ জানুয়ারিতে হঠাৎ করে খবর আসলো বাংলাদেশে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছিলো সেই বিচারের স্বপক্ষে শুনানির জন্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে পাঠানো হবে। বিশাল এক স্বপ্ন! যে যুদ্ধ দেশের মাটিতে করছি সেই যুদ্ধ দেশের বাইরে। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবার জন্য আমাকে সৈনিকের মত ঝাপিয়ে পরতে হবে। ৩১শে জানুয়ারি ২০১২ সালের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সে শুনানির দিন ঠিক করা ছিল ব্রাসেলসে।যেখানে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য জেনি ল্যামবার্ড সভাপতিত্ব করবেন।বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪ জন প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং কথা বলার সুযোগ পাবেন। আমি ছিলাম তাদের অন্যতম। যখন আমি দিন রাত এক করে নিজেকে তৈরি করছি প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য। তারই মাঝে আমাকে জানানো হল আমার বিষয়বস্তু ১৯৭১ সালের নারীদের উপর যে ধর্ষণ করেছে পাকিস্থানি বাহিনী এবং তাদের এই দেশী দোসর রা সেই ব্যপারে কথা বলতে হবে। নানা রকম সমালোচনা যে চলছিলো বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ আইন , বিচারিক প্রক্রিয়া কে নিয়ে সে ব্যপারে আমাদের যুক্তিযুক্ত এবং আইনি জবাব তুলে ধরতে হবে ।প্রস্তুতির এক পর্যায়ে হঠাৎ করে ফোন আসলো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আপার ।ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আপাকে আমি সামনা সামনি দেখেছি ২০১০ সালে যখন আমি নির্মূল কমিটিতে যোগদান করি।সবাই তাকে আম্মা বলে ডাকেন, কেউ বা মা কিন্তু কোন এক কারনে আমার এবং আপার মধ্যে সম্পর্কটা বোনের মতই থেকেছে।তাতে কিন্তু লাভ ছিল অনেক খানি কারন মা হলে হয়ত অনেক কথাই বলা যেত না কিন্তু বোনের মত যখন গল্প করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তখন আমাদের দূরত্ব টা অনেক কমে যেত।হঠাৎ আপা ফোন দিয়ে বললো “তুরিন একটু দেখা করে যেয়ো”
প্রায় কাজের ফাকে ধানমণ্ডিতে আমি আপার বাসাতে দেখা করতে যেতাম।তার সৃষ্টি কর্ম , শিল্প কর্ম গুলোকে দেখতাম।অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতাম পুরনো এবং মড়া গাছকে তিনি নতুন রূপে সাজাতেন।এই যে সব কিছুর কে নতুন রূপে সাজানো এটি তার অনাবদ্দ্য এক কাজ।একটা মড়া ডালকেও তিনি একেবারে নতুন রূপে সাজাতে পারতেন।তার সৃষ্টির মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে সে আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিতেন। ছুটে গেলাম তার কাছে তারপর দুপুরে খাওয়ালেন । তারপর উনি উনার শারীর আলমিরা টা খুলে সেখান থেকে তিনি লাল সবুজের একটি শাড়ি বের করে বললেন “ আপু তুমি তো ইউরোপে যাচ্ছ ।ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আমাদের হয়ে আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে যাচ্ছ। আমি তোমাকে একটি জিনিস দিতে চাই”।আমি দেখলাম তার হাতে লাল সবুজের একটি শাড়ি।তিনি বললেন “ এটি আমার পরনের শাড়ি আমি চাই তুমি যেদিন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তোমার বক্তব্য উপস্থাপন করবে, তুমি এই শারীটি পরে সেখানে আমাদের দেশের কথা বলবে , আমাদের দেশের বিচারের কথা বলবে, এবং বীরাঙ্গনাদের কথা বলবে। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম।এক তো চোখে অনেক স্বপ্ন এত বড় মঞ্ছে আমাদের দেশের কথা বলবো , কিভাবে উত্তর দেব । বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে হবে্, তাদের জন্য যে এই বিচারটি কত জরুরী সেই কথাটিও তুলে ধরতে হবে একাত্তরের সব কিছুকে মূর্তমান করে তুলবার জন্য।শাড়িটি আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম এবং অবাক হলাম। আপু সাধারণত সব ব্যাপারে খুব যত্নশীল। উনার এত নানা রঙের শাড়ি থেকে ঠিক লাল সবুজ শাড়িটি আমাকে বেছে দিল।আমি বললাম আপা আমি অবশ্যই এই শাড়িটি পরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করবো।যখন আমি ব্রাসেলসে গিয়ে পৌছাই তখন সাথে শাহরিয়ার কবির ভাই ছিলেন এবং আরও অনেক বাঙ্গালী সে দিন আমাদের সাথে সেই শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।এত ঠাণ্ডার মাঝেও আমি ওই সুতির শাড়িটি পরে ছিলাম।তখন খুব ভাল করে শাড়ি পরতে পারতাম না।কিন্তু যেহেতু আমাদের দলে আর কোন নারী ছিল না তাই একান্ত নিজ প্রচেষ্টায় সেই শাড়িটি যথাসম্ভব সুন্দর করে পরলাম। যে খানে শুনানি হয়েছিল সেই জায়গা থেকে গাড়ি অনেক দূরে রাখতে হয়।গাড়ি থেকে নেমে পথ হেঁটে অনেক খানি যেতে হয়। এখন ও মনে আছে শাড়ি পরার কারনে আমি কাঁপছিলাম। গায়ে লাল সোয়েটার ছিল বটে কিন্তু পা গুলো বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছিল ঠাণ্ডার ভিতর সুতির শাড়ির কারনেএবং আমি আসতে আসতে করে হাঁটছিলাম। শাহরিয়ার ভাই বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে কিনা। আমি তাকে জানালাম আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আমার যে বক্তব্য ছিল সেই বক্তব্যের দুটি অংশ ছিল ঃএকটি ছিল আমাদের বিচার আইন নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও সমালোচনা হচ্ছিল তাই প্রত্যেকটির আইনি জবাব তুলে ধরা। অন্য অংশে ছিল একাত্তরে নারী নির্যাতনের যে বীভৎস রুপ রয়েছে সেটি বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং এই আইনি যুক্তি উপস্থাপন করা যে কেন সেই কারনে যুদ্ধাপরাধীর বিচার এত জরুরী। আমি আমার বক্তব্য সেদিন শেষ করেছিলাম এই কথাটি বলে “ আপনারা যারা আজকে আমাকে দেখছেন আপনাদের সামনে শুনানি করলাম,আমার শরীরে যে শাড়িটি রয়েছে লাল সবুজের সেটি আমাকে দিয়েছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী । তিনি প্রথম নারী যিনি একাত্তরে নির্যাতনের কথা সর্ব সমুখে বলেছেন।তিনি আমাদের ইতিহাসের অনেক গৌরব গাঁথার মধ্যে নারীদের অবদানের কথা প্রথমবারের মত তুলে ধরেছেন।তার দেয়া শাড়ির মাঝে এই লাল সবুজের মোটিভে আমি বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা, দাবী এবং বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসা বেধে নিয়ে এসেছি। যাতে এই লাল সবুজের মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্ব আমাদের সমর্থন করে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য।এই শাড়িতে শুধু এক বীরাঙ্গনার কষ্ট ই নয়। লাখো লাখো বীরাঙ্গনার চোখের পানিকে আমি বেধে নিয়ে এসেছি আপনাদের সামনে। আমি অনুরোধ করছি একটি বার তাদের কথা ভাবুন এবং এই বিচারের স্বপক্ষে আপনাদের অবস্থান গ্রহন করুন। আমার এই বক্তব্যের পরে জেনি ল্যামবার্ড যিনি সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারেন নি। পোল্যান্ডের যে সদস্য ছিলেন তিনিও অশ্রু সজল চোখে বলছিলেন “তুরিন তোমার দেশে যে নারীরা নির্যাতিত হয়েছে একাত্তরে তাদের জন্য আমরা বিচার চাই। আমাদের যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের নারীদেরকেও একই ধরনের আত্ম ত্যাগ করতে হয়েছে। আজকে এত বছর পর যখন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় আমার কষ্ট দুঃখের সাথী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আপা। আপু বলে যাকে ডাকতাম। ব্যক্তিগত জীবনে যখন ই কোন কষ্ট হত, যখন ই কোন দ্বিধা দন্দের দোলায় পড়তাম নির্দ্বিধায় তার কাছে চলে যেতাম, কথা বলতাম মন খুলে। উনি স্বল্পভাষী ছিলেন। উনি মনোযোগ দিয়ে কষ্টের কথা শুনে হয়ত একটা উপায় বাতলে দিতেন। নিতান্তই বড় বোনের মত। তার আর আমার মাঝে যে সম্পর্ক তার মাঝে কোন বড়- ছোট, উঁচু–নিচু ভেদাভেদ ছিল না। যেন একটি বোন আরেকটি বোনকে তার দুঃখের কথা বলছে। কখন ও তিনি তার জীবন থেকে উদাহরন দিতেন কখন তিনি তার কষ্টের কথা বলে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন শক্তির আধার। ফেরদৌসী আপা যাকে সবাই প্রিয়ভাষিণী বলেন তিনি অল্প কথায় অনেক বেশী কিছু বুঝিয়ে গেছেন। তার চোখের ভাষায়, তার শিল্পে, তার কর্মে তার ছোঁয়ায় আদর করে কাছে ডেকে নিতেন। তিনি বার বার অনুযোগ করতেন আমার একমাত্র মেয়ে সুমেধা নিয়ে যাবার জন্যে যাকে তিনি আদর করে মেধা বলে ডাকতেন। আমার কন্যা সুমেধাকে নিয়ে আমার যে লড়াই সেই লড়াইয়ে তিনি একটা বিশাল বড় অংশ ছিলেন। তিনি যখন আমার বাসার কাছে বাড়ি নিলেন তখন আসলে পথের দূরত্ব ঘুচলেও ব্যাস্ততার কারনে যাওয়া আসা খানিকটা কমে গেল। বীরাঙ্গনাদের বিচার চেয়ে কায়সার এবং আজহারের মামলায় যখন আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে আদালতে তাদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হল। সেই মৃত্যুদণ্ডের কথা শুনে তিনি কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন একটা খুব বড় একটা কাজ হল।শুধু আমার জন্য নয় অনেক অনেক বীরাঙ্গনাদের জন্য।সবাই তোমার জন্য প্রার্থনা করবে। আবার আমি যখন বীরাঙ্গনাদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারলাম না তখন খুব কষ্ট পেয়ে বলেছিলাম “আপু আমার কাছে মনে হল ন্যায় বিচার পেলাম না।“ তখন তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন আমরা যা পেয়েছি সেটাই বা কম কি ?আমাদের কে আরও বেশী কাজ করতে হবে।এর পর আমার বর্তমান যে কাজ রয়েছে ৩৮৫জন বীরাঙ্গনাদের প্রত্যেকে ব্যক্তিগত ভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহন করে বর্তমানে যে বইয়ের কাজটি শেষ করেছি।সেই কাজেও তিনি অপরিসীম সাহায্য করেছেন।ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আপা শুধু একজন মানুষ ছিলেন না তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান ।তিনি ছিলেন শক্তির আধার।তিনি ছিলেন আমাদের সকলের সামনে এগিয়ে যাবার বাতিঘর। আমি তার শক্তির কিছুটা হলেও ধারন করতে চাই।আমাকে যেন সৃষ্টি কর্তা সেই ক্ষমতা দেয় তার মত হবার। সারাজীবন নির্লোভ থেকে মানুষকে কাছে টেনে নেবার যে ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল তার কিছুটা হলেও যেন সৃষ্টিকর্তা আমার মধ্যে দেয়।না তার জন্য আমি চোখের জল ফেলি না । কারন তিনি কোথাও জাননি , তিনি সব সময় আমার মাঝেই আছেন।
জয়তু ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আপা!
লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি