জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকবে কিনা, সে বিষয়ে আগামীকাল সোমবার (১৯ মার্চ) আদেশ দেবেন আপিল বিভাগ। রবিবার (১৮ মার্চ) সকালে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন।
আদালতে খালেদা জিয়াকে দেওয়া হাইকোর্টের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) ও রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল শুনানি হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার জামিন আদেশের বিরুদ্ধে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহাবুবে আলম। এছাড়াও জামিনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী ও খন্দকার মাহবুব হোসেন।
শুনানির শুরুতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে বলেন, ‘গত ১২ মার্চ চারটি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন।’ এসময় তিনি হাইকোর্টের আদেশের অংশটুকু পড়ে শোনান। তিনি বলেন,‘খালেদা জিয়াকে লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে।’ এরপর তিনি ৪৬ ডিএলআর একটি মাদকদ্রব্য আইনের মামলার রায়ের অংশ পড়ে শোনান, ‘ওই মামলায় একজনের দুই বছরের সাজা হয়েছিল। তবু বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ জামিন দেননি। হাইকোর্টে আমরা এই যুক্তি দেখিয়েছিলাম। হাইকোর্ট গ্রহণ না করে সাংঘর্ষিক আদেশ দিয়েছেন।’
হাইকোর্ট যে চারটি যুক্তিতে জামিন দিয়েছেন এর প্রথমটিতে হাইকোর্ট বলেছিলেন, খালেদা জিয়া জামিনের অপব্যবহার করেননি। এ প্রসঙ্গে দুদক আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) বিচারিক আদালতের অনুমতি না নিয়েই বিদেশে গেছেন। কাজেই হাইকোর্টের এই যুক্তি সঠিক নয়।’ মেডিক্যাল গ্রাউন্ডস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কোনও কাগজপত্র দেননি। বিচারিক আদালত তাকে দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ ধারায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫-এর ২ ধারায় দুর্নীতির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায়ও আদালত তাকে সাজা দেননি।’
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) একই সুবিধা দুই বার পেতে পারেন না। তিনি বয়স্ক মহিলা এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। এ কারণে বিচারিক আদালত দশ বছরের সাজা না দিয়ে তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া সমুচিত মনে করেছেন।’
এসময় আদালত বলেন, ‘এটি কি বিচারিক আদালত গ্রহণ করেছেন?’
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হ্যাঁ, গ্রহণ করেছেন। দশ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।’
তখন আদালত বলেন, ‘পাঁচ বছরের সাজা দেওয়ায় উনার শারীরিক অবস্থা কি ভালো হয়ে গেছে?’
জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এ মামলার রায়ের আগে ও পরে দুই মাস ২৫ দিন ধরে তিনি কারাগারে আছেন। হাইকোর্টে উনাকে চার মাসের জামিন দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন। পেপারবুক প্রস্তুত হলে শুনানি হোক সে পর্যন্ত তিনি জেলে থাকুক। আপিল নিষ্পত্তি হলে তিনি আবার জামিন আবেদন চাইতে পারবেন।’
তখন আদালত বলেন, ‘এই উপমহাদেশে জয়ললিতা, লালু প্রসাদ যাদব কতদিন কারাগারে ছিলেন?’
জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জয়ললিতার দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল ছিল। তার সহযোগী শশীকলা এবং অন্য আরেকটি মামলায় লালু প্রসাদ যাদব এখনও কারাগারে আছেন। কাজেই দুই মাস ২৫ দিনের মধ্যে জামিন পাবেন, এটা ঠিক হবে না।’
এ পর্যায়ে অ্যাটির্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমি সারসংক্ষেপ বলতে চাই।’ পরে তিনি মামলার বিস্তারিত পড়া শুরু করলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী আপত্তি তুলে বলেন, ‘এখন তো আপিলের শুনানি হচ্ছে না। মামলার সারবত্তায় (মেরিট) যাওয়ার দরকার কী?’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা মামলাটি একটু ভালো করে শুনি। আপনারাই বলেছেন, আমরা গতদিন শুনিনি। আমরা আপনাদের কথা পরে শুনবো।’
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা হলো একটা সারসংক্ষেপ। বিচারিক আদালতের রায়ে একজন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে— এতিমখানার টাকা উত্তোলনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার অনুমোদন ছিল। এর মধ্যে তারেক রহমান ও তার ভাগ্নে মুমিনুর রহমান চার লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। তারা কীভাবে এ টাকা তুলে নিলেন?’
আদালত বলেন, ‘এটা কি ব্যক্তি নামে ছিল?’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হ্যাঁ, ব্যক্তি নামে ছিল। এফডিআর করা নিয়ে একটা মামলাও হয়— কীভাবে বিদেশ থেকে টাকা এলো, কীভাবে এফডিআর হলো। তারা জমি কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল কিন্তু যখন জমি পাচ্ছিল না তখন তারা জমির জন্য চাপ না দিয়ে টাকা ফেরত চেয়েছে।’
আদালত জানতে চান মামলাটি কখন হয়েছিল? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘২০০৯ সালে হয়।’ এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল মামলার ধারাবাহিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘বিচার বিলম্বিত করতে তারা এমন কোনও পথ নেই যে অবলম্বন করেননি। এ মামলা যেন বাস্তবে না আসে সে জন্য তারা বেশ কয়েকবার উচ্চ আদালতে বিভিন্ন অজুহাতে আসেন। এটা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও গড়ায়। এ হলো তাদের আচরণ।’
মামলার নথি থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অজ্ঞাতে টাকা এসেছে বা তোলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না, এটা ঠিক নয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টের চারটি যুক্তির পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, ‘তাকে (খালেদা জিয়া) স্বল্প মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে, আর আপিল শুনানি হবে না, এটা অযৌক্তিক। আমাদের এ কোর্টে বিডিআর মামলায় ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আমরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক তৈরি করেছি।’
খালেদা জিয়া জামিনের অপব্যবহার করেননি— এ যুক্তির বিপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘এখন তিনি (খালেদা জিয়া) দণ্ডিত। এটা এখন বিচারাধীন বিষয়। একই যুক্তি এখানে প্রযোজ্য হবে না।’
খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ— এ যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বয়স্ক নারী। এ বিবেচনায় তাকে দশ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন বিচারিক আদালত। একজন আসামিকে কত বার এই সুবিধা দেওয়া হবে?
এখানে ফৌজদারী কাযবিধির ৪৯৭ ধারা প্রযোজ্য হবে, ৪২৬ ধারা নয়। রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দয়া এবং বার বার অনুকম্পা দেখানো ঠিক হবে না। কোনও রাষ্ট্রেই এটা দেখানো হয়নি।’
এরপর পাকিস্তানের এক মামলার নজির তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের জনতা টাওয়ার মামলায় সাড়ে তিন বছর সাজা হয়েছিল। উনি জেলও খেটেছেন।’
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘লালুপ্রসাদের সঙ্গে কি এ ঘটনার মিল আছে?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘লালুপ্রসাদের মামলা সুপ্রিম কোর্টেও তার জামিন খারিজ হয়েছিল। খালেদা জিয়াকে অসুস্থ বলা হচ্ছে, কিন্তু তিনি মিটিং-সমাবেশ করছেন, বিদেশ যাচ্ছেন, সবকিছু করছেন। আজকে যদি জামিন দেওয়া হয় তাহলে আপিলের শুনানি অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিতে পারেন, না-ও দিতে পারেন। তবে জামিন দেওয়াটাই স্বাভাবিক। লঘু দণ্ডের কারণে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। জামিন না দেওয়ার নজির খুবই কম। সাধারণত দেখা যায়, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের জামিনের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি। সীমিত ক্ষেত্রে আপিল বিভাগকে হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। যদি দেখা যায় ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারেন। হাইকোর্ট এ ধরনের মামলায় জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কর্তৃপক্ষ।’
এরপর আধাঘণ্টার বিরতিতে যান আদালত।
বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানির শুরুতে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘৪২৬ ধারায় মামলার সারবত্তা যাচাই করা হাইকোর্টের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাইকোর্টে আবেদন আসবে তারা এটা পুরোটাই দেখবেন। তারপর তারা জামিন দেবেন কি দেবেন না,সিদ্ধান্ত জানাবেন। আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেন না, যদি না এখানে বিচারের বিচ্যুতি ঘটে।’
এ সময় বিচারপতি ইমান আলী জানতে চান, বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট দণ্ড দিলে সেক্ষেত্রে আপিল বিভাগ কী হস্তক্ষেপ করতে পারে না? জবাবে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘অনেক মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। মুষ্টিমেয় মামলায় আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেননি। মামলার কাগজপত্র বা রায়ের কোথাও বলা হয়নি খালেদা জিয়া অর্থ আত্মসাতে জড়িত। তার (খালেদা জিয়া) স্বাক্ষর ছিল কোথাও বলা হয়নি। এটা পরিষ্কার যে, এ ধরনের জামিনের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেননি।’
এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সাজা যদি কম হয় তাহলে জামিন দিয়ে ভারসাম্যের ওপর জোর দিতে হবে। লাখ লাখ সাধারণ মামলা ছেড়ে দিয়ে এটাকে সামনে আনা হচ্ছে। এটাকেই আগে শুনতে হবে। উনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) অনেক বড় গল্প বললেন। আমি এটার জবাব দেওয়া সমীচিন মনে করি না। মামলাটি আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলুক। আমি মনে করি, হাইকোর্টের জামিনের সিদ্ধান্ত সঠিক।’
এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এটা খালেদা জিয়ার মামলা। তাই এ মামলার গুরুত্ব অনেক। তিনি না হলে আমরাও আসতাম না। সরকারও এত উৎসাহী হতো না। হাইকোর্টের ক্ষমতা আছে জামিন দেওয়ার।’
এ সময়ে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘দশ বছরের সাজার দু-একটি মামলা আছে যেগুলোতে জামিন মিলেছে। কিন্তু আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেননি।’
এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান পাকিস্তানের পারভেজ মোশারফ, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের মামলার নজির তুলে ধরেন।
পরে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত এ বিষয়ে আদেশের জন্য সোমবার দিন ধার্য করেন।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘গত সপ্তাহে একটি রায়ে নির্মিত ১৮ তলা ভবন এতিমখানাকে বুঝিয়ে দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। অতএব খালেদা জিয়ার মামলাতেও এতিমদের টাকা উধাও হয়েছে।’
এ সময় মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘শেখ হাসিনার মামলায় সরকার বা দুদককে এভাবে আসতে দেখিনি। যতটা না এ মামলায় দেখেছি।’ বাংলাট্রিবিউন