সদ্য সমাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৮-২০১৯ সেশনের নির্বাচনে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের ভরাডুবি হয়েছে। প্রায় দশ বছর ধরে আওয়ামীলীগ সরকারে থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দলীয় নেতৃত্ব হারিয়েছে বহুবার। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনে বারবার সরকার সমর্থকদের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে আইনজীবী নেতা ও সাধারণ আইনজীবীদের মতামত জানার চেষ্টা করেছে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। এতে উঠে এসেছে নানান ধরণের ক্ষোভ, হতাশা ও পরামর্শ।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবির কারণ জানতে চেয়ে ফেসবুক পোস্টের জনমত জরিপে উঠে এসেছে পরাজয়ের নানা কারণ। সাদা প্যানেলের ভরাডুবির কারণ হিসেবে মূলত প্রার্থী নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি, যোগ্যতর প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যর্থতা, সাধারণ আইনজীবীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ না রাখায় দূরত্ব তৈরি হওয়া, জুনিয়র আইনজীবীদের সাথে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক না রাখা, সমন্বয়হীনতার অভাব, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগ, দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের বিষয়সহ নানা কারণ উঠে এসেছে।
আইনজীবীদের উল্লেখযোগ্য মতামতসমূহের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শামীম সরদার আওয়ামীপন্থী প্যানেল নির্বাচনে ভালো করতে না পারার ৬টি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মতে –
‘প্রথম বা সর্বোচ্চ কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে- প্রার্থী হারে না, দল হারে! দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন ক্ষমতাসীন সরকারের নেতিবাচক কর্মকান্ড যেমন সারাদেশে প্রভাব ফেলে তেমনি সুপ্রীম কোর্টেও প্রভাব ফেলে। ইদানিং কালের যে সমস্ত বিষয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে তাহলোঃ একজন প্রধান বিচারপতির বিদায়, সুপ্রীম কোর্টে প্রবেশে আইনজীবীদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অসৌজন্যমূলক আচরণ, খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতের আদেশ, বহুতল ভবনের লোভ দেখানো ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, একক নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেওয়া। এবারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন নেতার হাতে নেতৃত্ব দেওয়াতে অনেক সিনিয়র আইনজীবী প্রকাশ্যে না বললেও ভিতরে ভিতরে বিরোধিতা করেছেন বা চুপ থেকেছেন। অনেক প্রথিতযশা আইনজীবী নেতাকে নির্বাচনে কাজ করতে দেখা যায় নাই।
তৃতীয়ত, এটর্ণী কার্যালয়ে ডিএজি এএজি নিয়োগে অনিয়মিত প্রাকটিসনার ও জজ কোর্ট প্রাকটিশনাদের নিয়োগে প্রাধান্য দেওয়া।
চতুর্থত, ইন-একটিভ আওয়ামী কর্মীদের একটিভ করতে ব্যর্থতা।
পঞ্চমত, দূর-দূরান্ত থেকে ভোটার আনতে না পারা বা যে সমস্ত আওয়ামীপন্থি আইনজীবী রেগুলার প্র্যাকটিস করেন না তাদেরকে ভোটের দিন আনতে না পারা।
ষষ্ঠত, চাটুকারিতা একটি বড় বিষয়। আইনজীবী নেতাদের চারপাশে শুধ চাটুকারদের ভিড়। (কিছু দুষ্টলোকতো মুচকি হেসে বলে কিছু কিছু নেতার চারপাশে শুধু চাটুকার আর মহিলা আইনজীবী, চলে সেলফি)।’
অ্যাডভোকেট শাহিনুর রহমান শাহিন মনে করেন, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন নির্বাচন প্রসঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে শুরুতেই একটি উদাহরণ দিতে চাই। এবারের ঢাকা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে সুপ্রিম কোর্ট বার এ নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন এমন কয়েকজন বিজ্ঞ আইনজীবী ভোট দিতে এসে বলাবলি করছিলেন যে, এবার ঢাকা বারের আইনজীবীরাইতো এএজি, ডিএজি হল, তো সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে তাদের ব্যাপক প্রভাব পরিচিতি দিয়ে সাদা প্যানেলের জয় নিশ্চিত করে ফেলবে। বোঝাই যায় উনাদের ক্ষোভের মাত্রা কত বেশি। দীর্ঘদিন রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীদের স্বপদে বহাল এবং তাদের আচরণে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের অসন্তুষ্টি। অথচ ত্যাগী এবং অপেক্ষাকৃত বেশি যোগ্যরা অবহেলিত দীর্ঘদিন। কিছু সিনিয়র আইনজীবী নেতা যারা নেতৃত্বে এবং আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ তারা তরুণ নেতৃত্ব উপর থেকে মানলেও ভিতরে ভিতরে বিরোধিতা করেছে, অর্থাৎ মেনে নিলেও মনে নেয়নি।
আইনজীবী কিন্তু প্র্যাকটিস করেন না, আবার আওয়ামীলীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের বড় দলীয় পদে আছে, নির্বাচনের সময় কোর্ট প্রাঙ্গণে দলীয় পদের কারণে তাদের প্রভাবশালী দাপুটে আচরণ সাধারণ আইনজীবীদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এ আইনজীবীদের প্রবেশে পুলিশের অসৌজন্যমূলক আচরণে প্রচুর সংখ্যক আওয়ামীপন্থি সাধারণ আইনজীবী বিব্রত হয়েছেন এবং যথাযথ দ্বায়িত্বশীলরা কর্তৃপক্ষ দ্বারা সময়মত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচনী টিমের অনেক সদস্যই নির্বাচনকালীন শিষ্টাচার বিনিময়ে ব্যাপক গাফিলতি দেখিয়েছে, যেমন কেউ একজন প্রচার টিমে আছেন অথচ একজন আইনজীবীর সাথে সালাম বা কুশল বিনিময় করতেও তাদের মধ্যে অহংকার পরিলক্ষিত হয়েছে।
আওয়ামীপন্থী সিনিয়র আইনজীবীদের নিজের জুনিয়র ছাড়া অন্য জুনিয়র আইনজীবীদের সাথে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। একইসঙ্গে আওয়ামীপন্থি আইনজীবী নেতাদের জুনিয়র আইনজীবী এবং সাধারণ আইনজীবীদের সাথে হামবড়া আচরণ এবং বিগত সময়ে আওয়ামীপন্থিরা যখন বিজয়ী হয়েছিল সে সময় আইনজীবীদের সমস্যা সমাধানে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ও অনীহা ছিল বলেও আমি মনে করি।
এছাড়া, কিছু সুযোগ সন্ধানী পদধারী আইনজীবীর নোংরা ইজম বানিজ্য ছাড়াও আরো কিছু ত্রুটি রয়েছে যার কারনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে আওয়ামীপন্থিদের পরাজয় হয়েছে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি।
আশাকরি প্রাজ্ঞ এবং বিজ্ঞজনেরা নিশ্চয় এরচেয়েও সঠিকভাবে কারণ খুঁজে বের করে দলের প্রয়োজনে যথোপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারবেন।’
আইনজীবী শাহিন হাওলাদার মনে করেন, ‘আওয়ামীলীগ সমর্থিত আইনজীবী নেতারা প্রত্যেকেই নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন যারা দলের স্বার্থের থেকে নিজেদের অবস্থানকে বেশী গুরুত্ব দেন, সিনিয়র নেতাদের আত্ন অহংকারী হয়ে ওঠা, বিচারক ও ডিএজি নিয়োগে যোগ্যদের অবমূল্যায়ন করার কারণেই এমন ভরাডুবি।’
সিজান এহসান নামের একজন উল্লেখ করেন, ‘একটাই কারণ গ্রুপিং, চার জন মিলেই একটা গ্রুপ, আওয়ামীলীগ বিভিন্ন দরবেশের অনুসারী হওয়ায় ভরাডুবি। বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও সমন্বয় পরিষদ দ্বিধা বিভক্তি রয়ে গেছে।শ্রদ্ধেয় রাবণেরা মাইনাস করার জন্য ভোটারাধিকার প্রয়োগ করেছেন অন্য শিবিরে।’
শেখ জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগের এত সফলতার মাঝে সুপ্রীম কোর্টের আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বার বার হারছেন কারণ নেতারা মন থেকে সবাইকে ভালবাসেন না বা মন দিয়ে আন্তরিকতার সহিত মিশতে জানেন না। তবে নেতাদের মনে রাখা উচিত আইনজীবীরা স্বাধীন পেশার মানুষ।’
আইনজীবী মহিউদ্দিন চৌধুরী শরীফ বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই জিতে যাওয়ার ভাব নেওয়া এবং অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দিলে নির্বাচনের বিপরীত ফল বয়ে আনে।’
অ্যাডভোকেট নাজমা কাওসারের মতে, আমাদের এমপি, মন্ত্রীসহ অনেক নেতা, যারা এ সমিতির সদস্য তাদের অনেকেই ভোট দিতে আসেননি। সময় কোথায়!’
সদ্য বিদায়ী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট হাসিবুর রহমান মনে করেন, ‘যোগ্য প্রার্থীর বড্ড অভাব। কারণ ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি এক প্রার্থী সর্বোচ্চ ৪ বার পর্যন্ত মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে।’
বিভিন্ন সময় পদ ও সুযোগবঞ্চিত হয়ে এক ধরণের অভিমানের সুরে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক সম্পাদক ও আইনজীবী নেতা ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বলেন, ‘আমার মত ডিসকোয়ালিফাইডদের রেস্টে পাঠিয়ে দিন।’ এছাড়া এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য তাঁর মন্তব্যে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘প্রত্যেক আইনজীবী ও কর্মীর সাথে ভাল আচরণ করতে হবে এবং একইসঙ্গে স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।’
ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুর রব খানের মতে, ‘ছবি/সেলফি তুলে নির্বাচনে জয় সম্ভব না।’ পাশাপাশি যোগ্য এবং সত্যিকারের কর্মীদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার গুরুত্বারোপ করেন আইনজীবী আব্দুর রব খান।
কাজি ফয়েজুর রহমান; সহকারী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম