মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী:
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি, শনিবার, সকাল সাড়ে ৯ টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ ঘন্টা কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দীজীবন কাটিয়েছি। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, নজিরবিহীন শৃংখলা, কারা অভ্যান্তরের প্রতিটি স্থরে নান্দনিক শিল্পের ছোঁয়া, জেল কর্মকর্তা-কর্মী ও বন্দীরা যৌথভাবে ফুলেল ও সুরের মুর্ছনায় উষ্ণ অর্ভ্যথনা জানানো, হৃদয় নিংড়ানো অথিতিয়েতা ও আপ্যায়ন, বন্দীদের দুঃখ ও সমস্যার কথা সরাসরি অপকটে শুনতে পাওয়া, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কারা ইতিহাসে সংযোজন হলো এক নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায় কারা ইতিহাসের এক মাইলফলক হিসাবে স্থান করে নিলো।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির উদ্যোগে কক্সবাজার জেলা কারাগারে কারাবন্দীদের মাঝে আইনগত সহায়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অনুষ্ঠিত ব্যতিক্রমধর্মী এ সভা নিঃসন্দেহে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি এবং জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম ছিলেন এই সভার প্রাণপুরুষ তথা প্রধান অতিথি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট খালেদ মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পুরো সভাটি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় সঞ্চালনা করেন সিনিয়র সহকারী জজ ও সফল লিগ্যাল এইড অফিসার তাওহীদা আক্তার। সভার শুরুতেই বন্দীদের দিয়ে পবিত্র কোরআন, গীতা ও বেদ পাঠ করানো হয়। এরপর জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন, অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সফল কারিগর জেল সুপার বজলুর রশিদ আখন্দ। বন্দীদের পক্ষে ২ জন বন্দী সভায় তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা অপকটে সবিস্তারে তুলে ধরেন। এছাড়াও অস্বচ্ছল ও অসহায় বন্দীদের সরকারীভাবে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তার উপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ওসমান গণি, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মুহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নুরুল আমিন মিয়া, জিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এড. মুহাম্মদ ইসহাক, সাধারণ সম্পাদক এড. জিয়া উদ্দিন আহমদ, পাবলিক প্রসিকিউটর এড. মমতাজ আহামদ, সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী এড. আবুল কালাম আযাদ, এড. সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউর রহমান প্রমূখ। সভায় জেলা জজশীপ ও চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের প্রায় সকল বিজ্ঞ বিচারক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ, ২৮ জন বিজ্ঞ প্যানেল আইনজীবী, এনজিও প্রতিনিধি, মিডিয়াকর্মীসহ লিগ্যাল এইড্ সম্পর্কিত জেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
জেলার শাহাদত হোসাইনের দেয়া তথ্য মতে, ঐদিন কারাগারে মোট ৩১০৪ জন বন্দীর প্রায় সকলেই এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। যে বন্দীর সংখ্যা জেলা কারাগারের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ৬ গুনের বেশী। কারাভ্যন্তরে দর্শক সারিতে এসব বন্দীরা অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে বসা ছিলেন। বন্দীদের মাঝে ছিল পিনপতন নিরবতা। ৩ সহস্রাধিক বন্দীদের নিয়ে এ সচেতনতামূলক সভা করা একটা বিরাট ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা ও স্পর্শকাতর বিষয় হলেও মূলতঃ সেখানকার পরিবেশ ছিল খুবই প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য। ক্ষনিকের জন্যও মনে হয়নি কারাভ্যন্তরে ৩ সহ¯্রাধিক বন্দীকে নিয়ে সভা করছি। মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাত্র কয়েকফুট সামনেই কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ৩ সহ¯্রাধিক বন্দীদের সুশৃংখল নজরকাড়া অবস্থান দেখে মনে হয়েছে যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট ও শান্তিকামী এক বাহিনীকে নিয়ে এসভা চলছে। যেন আলোকিত এক স্বপ্নীল ভূবন। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বন্দীদের নিয়ে কারাভ্যন্তরে এটি বৃহত্তর পরিসরে দেশের প্রথম সভা। এর আগে চাঁদপুর জেলা কারাগারে মাত্র ৪ শতাধিক বন্দী নিয়ে ক্ষুদ্র একটি সভা হলেও সূত্র মতে, বৃহত্তর পরিসর, দীর্ঘসময়, শৃংখলা ও সফলতার দিক দিয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারের এ সভাটি ছিল দেশের প্রথম শতভাগ সফল সভা, যা জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি ও জেলা কারাগারের জন্য সফলতার এক উজ্জল উদাহরণ। কারাগারে প্রবেশের পূর্বে মনে যে শংকা, শিহরণ জেগেছিল, কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে মধুময় ও নিরাপদ পরিবেশে দেখে বরং ধারণা ঠিক উল্টো হয়ে গেলো। জেলা লিগ্যাল এইড্ কমিটি ও জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের এ সফল ও দৃষ্টান্তমূলক অর্জন নিঃসন্দেহে কারা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। কারা ইতিহাসের এক নব অধ্যায়ের সুচনা লগ্নে নিজেকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত রাখতে পেরে গর্ববোধ করলাম। এ সভার মাধ্যমে বন্দীরা জানতে পেরেছে, কারাগার যে শুধু শাস্তিভোগ করার জায়গা নয়, বন্দীদের জন্য কারাগার হচ্ছে, একটি উত্তম সংশোধন কেন্দ্র তথা নীতি নৈতিকতা ও ইতিবাচক আদর্শে ও অপরাধবিমুখ হয়ে গড়ে উঠার একটি উত্তম ক্ষেত্র। অসহায়, অক্ষম ও অস্বচ্ছল বিচার প্রার্থীদের জন্য সরকারীভাবে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দেয়ার যে সুযোগ রয়েছে, সে বিষয়েও বন্দীরা খুব ভালভাবে জ্ঞাত হয়েছে।
সভায় প্রধান অতিথি জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম বলেন, ভৌগলিক কারণে কক্সবাজার হচ্ছে মাদক, মানব পাচার, জলদস্যুতা ও স্মার্কলিংয়ের অন্যতম রুট। এ রুটে সামান্য অর্থের লোভে সাধারণ লোকজন মাদক ও নিষিদ্ধ পণ্য বহন করে থাকে। বহনকারীরা আইনের আওতায় আসলেই তার পুরো পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। যে কোন ধরনের মাদক ও নিষিদ্ধপণ্য সমাজ, দেশ ও পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনে উল্লেখ করে বন্দীদের ছাড়া পাওয়ার পর মাদক বহনসহ যে কোন ধরনের অপরাধ কর্ম থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি বন্দীদের প্রতি আহবান জানান।
লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ও প্যানেল আইনজীবী, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি, কক্সবাজার।