আদালত অঙ্গনে টাউট প্রসঙ্গটি এত বেশী উচ্চারিত হয়, যে এই প্রসঙ্গটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করে উপায় নাই। এই টাউটরা আদালতে বিচার প্রার্থীদের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি বিভিন্নভাবে ন্যায় বিচারের অন্তরায়ও বটে। সম্প্রতি টাউট প্রসঙ্গে বিজ্ঞ বন্ধু রানা সরদার এর কালো ব্যানারে একটি প্রতিবাদী পোস্ট দেখে আমার এই লেখার অবতারণা। রানা লিখেছেন, “ঢাকা বার থেকে টাউট উচ্ছেদ করা কি আদৌ সম্ভব?? আমার তা মনে হয়না।” । ঐ পোস্টটির নিচে আড়াই শতাধিক রিঅ্যাকশন ও শতখানেক কমেন্ট পড়েছে। কেউ হতাশা ব্যাক্ত করেছেন, কেউ টাউট নির্মূল অসম্ভব নয় বলেছেন, কেউ টাউট নির্মূল বা প্রতিরোধের পথ বাতলে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে আমার বক্তব্য নিম্নরূপ-
বাংলাদেশের প্রত্যেকজন বিজ্ঞ আইনজীবী যদি মনে করেন যে টাউট নির্মূল করতে হবে, তাহলেই টাউট নির্মূল হবে। আইনজীবী সমিতি যেটা করে তা হল টাউট প্রতিরোধের চেষ্টা। আইনজীবী সমিতি টাউটদের ধরে, আইনে সোপর্দ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতির টাউট বিরোধী অভিযানের সফলতা, বিফলতা নিয়ে বিতর্কও ওঠে। কেন বিতর্ক ওঠে তা আইনজীবী মাত্রই অবগত আছেন বলে মনে করি। তাই এবিষয়ে আলোচনা না করে অন্য কথায় আসি। টাউটের উৎপত্তি হল কবে কোথায়? টাউট শব্দটি ইংরেজি শব্দ। এই ইংরেজি শব্দটিকে প্রথম চিহ্নিত করা হয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে। টাউট শব্দটি আমাদের আইন অঙ্গনে এত বেশী উচ্চারিত হয়, যে এই শব্দটি বা বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক মনে করি। সেই আবশ্যকতার দৃষ্টি কোন থেকে এই শব্দ টির বিষয়ে জানতে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পাই, অভিধানে এর অর্থ করেছে, “to sell (something), typically by a direct or persistent approach”. আরও বিভিন্ন অর্থ আছে। অনলাইনে সার্চ দিলে পেয়ে যাবেন। কোথাও টাউটের অর্থ বলে হয়েছে solicitor, কোথাও বলে হয়েছে spruiker, আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ায় ভিন্ন শব্দে টাউটের পরিচয় হয়। তবে সব যায়গায় খারাপ অর্থে টাউটের পরিচয় হয়। তবে ভারতীয় উপ মহাদেশ এবং কালের পরিক্রমায় স্বাধীন বাংলাদেশে টাউটের উৎপত্তি হল কবে থেকে তা আমার পক্ষে জানা এখনো সম্ভব হয় নাই। আইনের দৃষ্টিতে দেখা যায়, ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইনের ৩ নং ধারায় টাউটের সংজ্ঞা ও ৩৬ ধারায় টাউটের তালিকা প্রণয়নের কথা বলা হয়। পরবর্তীতে ১৯২৬ সনের বার কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৬৫ সনের দি লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট এই সকল আইনের সব গুলিতেই টাউট সম্পর্কিত ধারা যুক্ত করা হয়।
১৯৭২ সনের বার কাউন্সিল অর্ডারে টাউট সম্পর্কিত ধারা না থাকলেও টাউটিং এর পর্যায়ে পড়ে এমন কর্মকাণ্ড করতে নিষেধ করা হয়েছে। ১৯৭২ সনে দি বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার পাশ করা হয় ও ঐ আইনের ৪৫ অনুচ্ছেদে ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইন বাতিল করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ কোডে যে ১৮৭৯ সনের টাউট আইন দেখা যায় তা আসলে ১৮৭৯ সনের আইনজীবী আইন থেকে চয়ন করা ১, ২, ৩, ৩৬ ও ৩৬এ ধারা সমূহ। ১৮৭৯ সনের আইনে টাউটিং এর শাস্তি বিধান করা হয়। যাহোক টাউট শব্দটি বা বিষয়টি নিয়ে, যতটুকু পড়াশুনা করতে পেরেছি তাতে এটা প্রতীয়মান হয়েছে, যেন আইনজীবী আর টাউট শব্দ দুটি পাশাপাশি অবস্থান করেছে। যেখানেই আইনজীবী আইন সেখানেই আছে টাউট আইন। আইনজীবী আর টাউট যেন জড়াজড়ি করে আছে। আইনজীবী আর টাউট যেন পাশাপাশি চলে। যেখানেই আইনজীবী সেখানেই যেন টাউটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রফেশনাল কন্ডাক্ট অ্যান্ড এটিকেট এর চ্যাপ্টার ১ এর ৩ নং দফায় ( an Advocate shall not employ any other person to solicit or obtain professional employment nor remunerate another for soliciting or obtaining professional employment for him; nor shall he share with an unlicensed person any compensation, arising out of or incidental to professional employment, nor shall he aid or abet an unlicensed person to practice law or to receive compensation thereof; nor shall he knowingly accept professional employment offered to him as a result of or as incidental to the activities of an unlicensed person.) “এনি আদার পার্সন”ই টাউটদের। অর্থাৎ টাউট রাখা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে টাউট পালন করা, টাউটের কাজে কাউকে নিয়োগ করা, টাউটের কাজে কাউকে উৎসাহিত করাকে প্রফেশনাল মিসকন্ডাক্ট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই অপরাধের জন্য আইনজীবী লাইসেন্স বাতিল করার ব্যাবস্থা পর্যন্ত রাখা হয়েছে। টাউট পালন করা মানে আইনজীবী শপথ ভঙ্গ করা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কেউ আর্থিক লাভের আশায় টাউটের কাজ করছে। অনেক উকিল সাহেব আর্থিক লাভের আশায় টাউটের নিকট থেকে মামলা গ্রহণ করছেন। মামলা পাওয়ার আশায় অনেক উকিল সাহেব টাউট লালন পালন করছেন।
টাউট পালন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে “সর্বঅঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দিব কোথা” এমন হয়েছে। থানা থেকে লঞ্চ, রেল, বাস ষ্টেশন। রাজস্ব অফিস থেকে জেলা প্রশাসকের অফিস। সহকারী কমিশনার ভূমি থেকে রেজিষ্ট্রি অফিস। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত। দেওয়ানী, ফৌজদারি, রিট। এমন কোন জায়গা নেই যে সেখানে টাউট নেই। কেন এরা থাকতে পারছে তা সকলের জানা। কিভাবে এদের নির্মূল করা যায় তাও সকলের জানা। কিন্তু সমস্যা হল সকলে মিলে আইন না মানা। জেলা প্রশাসক অফিসের, রাজস্ব অফিসের দায়িত্ব আছে টাউটের তালিকা প্রণয়ন করা, তাঁরা তা করেন না। আইনজীবী সমিতি অনেক সময় করলেও আমাদের অনেকেই তাঁদের সহযোগিতা করিতো না বরং আমাদের মধ্যে অনেকেই অসহযোগিতা করি। আবার “আইনজীবী সমিতির শর্ষের মধ্যেই ভূত” সমালোচনাও শোনা যায়।
হাইকোর্টেও টাউট থাকে। তাঁরা অনেক উচ্চ মানের টাউট। তাঁদের আবার নানা রকমফের আছে। যেমন আমার এক বন্ধু একটি মামলা শুনানি করলেন, আদালত না মনজুর করলেন, আমার বিজ্ঞ বন্ধু যথা নিয়মে মাচ অবলাইজ দিয়ে আদালত থেকে বের হতেই, কেতাদুরস্ত একলোক আমার বন্ধুকে বলছেন, “স্যার আপনার এই পিটিশন না মনজুর হল, অমুক স্যারকে দিয়ে শুনানি করেন, আপনার পিটিশন মঞ্জুর হবে ১০০%।” ঐ কেতাদুরস্ত আসলে অমুক স্যারের দালাল। আমার বন্ধু বুঝলেও কিছু বলার নাই। অমুক স্যার অনেক উচু মানের। তাঁর নাম বলার সাহসও আমার বন্ধুর হবেনা। একটা উদহারন দিলাম মাত্র। আমার চেয়ে আমার বিজ্ঞ বন্ধুরা এসব অনেক ভাল জানেন। আবার অনেক দালাল আছে, জেলা আদালতগুলিতে ঘোরাফেরা করে, সুযোগ মত মামলার পক্ষদের নিয়ে টাউটারি করে। এভাবে অনেক রকম। থানায় কি হয়, লঞ্চ, বাস ট্রেন স্টেশনে কি হয়, সবাই তা জানেন। আমার না লিখলেও চলবে মনে করি।
টাউট নির্মূলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলও কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল টাউট দমনের জন্য নজরদারী করতে পারে। টাউটিং এর জন্য ১৮৭৯ সনে যে শাস্তি বিধান করা হয়েছিল তা সংশোধন করে টাউটিং এর শাস্তি বাড়ানো উচিৎ বলে মনে করি। টাউটিং ন্যায় বিচারের জন্য অন্তরায়। আদালতে বিচার প্রার্থীদের জন্য ক্ষতির কারণ। আমার যেটা মনে হয়েছে, টাউট নির্মূলের সবচেয়ে ভাল উপায় হল বিজ্ঞ আইনজীবীদের আইন মেনে টাউটদের প্রশ্রয় না দেওয়া।
(সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী হেলাল উদ্দিনের ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগ্রহ)