প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আইনটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার আগে এ বিতর্কিত ধারাগুলোতে সংশোধন আনার আহ্বান জনিয়েছেন তারা।
আজ (বুধবার) জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যমের বর্তমান চিত্র’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
এমআরডিআই ও ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় সেমিনারটির আয়োজন করেন কমলওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ), বাংলাদেশ।
সিজেএ এর সহসভাপতি আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত।
অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, আইনটি যদি এ অবস্থায় সংসদে পাশ হয় তাহলে এটা আরও অনেকগুলো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। পাবলিক ইন্টারেস্ট ইনফরমেশন ২০১১ এ যে বিধানটা রয়েছে সেটার সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হবে। ওইখানে বলা হয়েছে- যদি কারো নিকট তথ্য থাকে যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হচ্ছে তাহলে তথ্য পাবলিশ করার জন্য তাকে অনুমোতি দেয়া হয়েছে। অথচ নতুন বিধানে বলা হয়েছে এই কাজটিই যদি আপনি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে করেন তাহলে আপনার শাস্তি হবে।
তিনি বলেন, এক আইনে বলা হচ্ছে আপনি প্রকাশ করলে কোনো সমস্যা হবে না। আবার প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হচ্চে সেটি করলেই আপনার ১৪ বছর জেল হবে। এভাবে এ আইনের ৫টি ধারা সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের সাংঘর্ষিক আইন আমাদের সংবিধানে অনুমোদন করে না। এসব সাংঘর্ষিক ধারাগুলোতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম অন্য একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দেখা যাচ্ছে ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। এ সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পেছনে পড়ে আছে। এ সূচকে আফগানিস্তান, নেপাল, ভূটান তো এগিয়ে আছেই, এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
তথ্যপ্রযু্ক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা এবং প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, সংবাদ সংগ্রহ করার সময় আমাদের দেশে সাংবাদিকেরা হরহামেশা হতাহত, জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। শুধু প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ মার্চ মাস পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন একজন সাংবাদিক। বিভিন্ন ঘটনায় আহত অন্তত আটজন। জেলে গেছেন অন্তত তিনজন। গ্রেফতার ও আটক পাঁচজন। ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অপহরণ করা হয়েছে অন্তত একজনকে, অবশ্য পরবর্ততে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ পরিসংখ্যানে সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা-হয়রানির হিসাব উল্লেখ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, সবাই মূলত সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের রোষানলে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সংবাদ প্রকাশের কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। ব্যক্তিগত রেষারেষি বা স্থানীয় দলাদলির কারণে সাংবাদিকতার বাইরে কোনো ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এখানে ধরা হয়নি। শুধুমাত্র সাংবাদিকতার কারণে অভিযুক্ত হয়ে নির্যাতিত হওয়ার হিসাবই এখানে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অবশ্য সব খবর পত্রিকায় আসে না। আবার শুধু একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হসাব এটি। নির্যাতিত সাংবাদিকের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। তাই প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্বারা সাংবাদিকরা যেনো কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
এর আগে গত ১৯ এপ্রিল জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদের সংগঠন এডিটর’স কাউন্সিল আইনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মাদ শহিদুল হক। ওই বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বলে জানানো হয়।
বৈঠক শেষে এডিটর’স কাউন্সিলের জেনারেল ও দ্যা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরর ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এসব ধারা ধারাগুলোর সংশোধন দাবি করে এডিটর’স কাউন্সিল। (জাগো নিউজ)