ড. মিজানুর রহমান
সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম, বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী পরলোকগমন করেছেন। ধানমণ্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি ধানমণ্ডিতেই থাকি। অথচ অসুস্থ হয়ে বিচারপতি চৌধুরী যে আমার বাসস্থান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন, তা জানতে পারিনি। আর তাই শেষবারের মতো তাকে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। তার মৃত্যুসংবাদ জানার পর থেকে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে আমার ভেতরে। তিনি মৃত্যুশয্যায়- এই সংবাদটি কেন জানতে পারলাম না?
ভীষণ রকমের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, প্রাণখোলা নিখাদ এক ভদ্রমানুষ ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অর্ডিন্যান্স দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি চৌধুরী। অগণতান্ত্রিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশন কীভাবে ও কতখানি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে- এই চিন্তা বিচারপতি চৌধুরীকে ভীষণ ভাবিত করেছিল। কিন্তু সামনের অন্ধকারকে ভয় না পেয়ে তা অতিক্রম করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও অন্তর্নিহিত শক্তির সাহায্যে ভয়কে তিনি জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভাবতে অবাক লাগে, দু’জন কমিশনার (সদস্য) ছাড়া আর কোনো কর্মীর হাত তাকে দেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারিভাবে কোনো অফিসও বরাদ্দ করা হয়নি। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ের বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য হেঁটে ঘুরেছেন মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, লালমাটিয়ায়। অবশেষে লালমাটিয়ায় ভাড়া করা বাসায় যাত্রা শুরু হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের। খবরের কাগজে তখন ছবিসহ সংবাদ দেখেছি স্বয়ং বিচারপতি কবির চৌধুরী- জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, নিজ হাতে চেয়ার বহন করে অফিসঘর সাজাচ্ছেন।
বহির্বিশ্বে তৎকালীন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য মানবাধিকার কমিশন গঠন করাটা হয়তো-বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ‘ঢাল নাই, তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’ হয়ে মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে মানবাধিকার সুরক্ষার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু বিচারপতি কবির চৌধুরী সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। হয়তো তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি যথেষ্ট প্রসারিত ছিল না, হতে পারে কমিশনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাধারণ জনগণ ততটা অবহিত ছিলেন না; কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের যে যে ক্ষেত্রে কাজ করা প্রয়োজন, তার শুরুটা করেছিলেন প্রয়াত চেয়ারম্যান বিচারপতি চৌধুরী। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জুন মাসে ‘জাতীয় মানবাধিকার আইন-২০০৯’ প্রণয়ন করলেও বিচারপতি চৌধুরী তার কাজ অব্যাহত রাখেন ও শেখ হাসিনার সরকার বিচারপতি চৌধুরীর মেয়াদ পূর্ণ করার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেননি। ২০১০ সালের ২২ জুন ৭০ বছর পূর্ণ হলে বিচারপতি চৌধুরী মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসরে যান।
আজ মনে পড়ছে, ২০১০ সালের ২৩ জুন সকাল ১০টার দিকে মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য যখন লালমাটিয়ার কমিশনের কার্যালয়ে উপস্থিত হই, দেখি বিচারপতি চৌধুরী অপেক্ষা করছেন। বললাম, ‘স্যার, আপনি?’ তিনি স্বভাবসুলভ নম্রতায় জবাব দিলেন- ‘আপনাকে এ চেয়ারে নিজ হাতে বসিয়ে দেব- তাই অপেক্ষা করছি।’ বাঁধভাঙা আবেগে আমার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম- বাংলাদেশে এ রকমও হয় নাকি? বয়স্ক একজন বিচারপতির এ কী সৌজন্যবোধ! আত্মশক্তি ও আত্মমহিমায় কতটা বলীয়ান হলে একজন মানুষ এতটা ‘মাটির মানুষ’ হতে পারেন! স্যার আমাকে আলিঙ্গন করলেন, তারপর হাত ধরে চেয়ারম্যানের আসনে আমাকে বসালেন। তারপর বললেন, ‘আজকের মতো আমার দায়িত্ব শেষ। তবে ড. মিজান, যখনই প্রয়োজন মনে করবেন, আমাকে স্মরণ করবেন। আমার দ্বার আপনার জন্য সদা উন্মুক্ত।’
স্যার তার কথার বরখেলাপ করেননি। শিক্ষকতা থেকে কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার ফলে আমার অনেক কিছু জানার ও বোঝার ছিল। যখন-তখন
স্যারকে ফোন করেছি। উপদেশ চেয়েছি, কী করণীয় জানতে চেয়েছি- কোনো দিন বিমুখ করেননি।
বরং কমিশনের কাজের পরিধি বৃদ্ধি করতে যখন হাসপাতালে গেছি, জেলখানায় গেছি, শিশু সদনে গেছি বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেছি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার কোনো ছাত্র বা নাগরিককে দেখতে গেছি, প্রতিবারই বিচারপতি চৌধুরী ফোন করে সাধুবাদ জানিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। মনে পড়ছে, মানবাধিকার রক্ষায় আঞ্চলিক উদ্যোগ গ্রহণের এক সেমিনারে বক্তা হিসেবে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি বক্তব্য শেষে আমাকে একটি ফাইল দেখালেন এবং বললেন, ‘ড. মিজান, এই ফাইলে মানবাধিকারবিষয়ক সবকিছু, সব পেপার কাটিং, আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। যখনই প্রয়োজন হবে, বললেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’
বিদায়কালে তিনি বললেন, ‘ড. মিজান, আমি যা পারিনি, আপনি তা পেরেছেন। আমি আপনার জন্য গর্ব অনুভব করি। আপনার জন্য দোয়া করি।’
স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। যতদিন কমিশনে ছিলাম, আমাদের সব সেমিনার, কনফারেন্স, সভায় প্রথম আমন্ত্রণপত্রটি লেখা হতো স্যারের ঠিকানায়। সুস্থ থাকলে, কোনো অনুষ্ঠানে তিনি অনুপস্থিত থাকেন না।
বিনয়ী, সদালাপী, আপদমস্তক একজন ভদ্রলোক- বিচারপতি চৌধুরী আজ লোকায়ত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা আরও বিস্তৃত হোক, সাধারণ নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হোক, মানবাধিকার কমিশন আমলামুক্ত হয়ে সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষায় রক্ষাকবচ হয়ে উঠুক- এটি হোক বিচারপতি কবির চৌধুরীর
প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আপনার অবদানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ‘অশেষ’ হয়েছে।
স্যার, আপনি শান্তিতে থাকুন!
লেখক- অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ