উচ্চ আদালতের বিভিন্ন ধরনের ৫৮৬৮ রিট মামলায় প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আটকে গেছে। এরমধ্যে অর্থঋণ সংক্রান্ত রিট মামলার সংখ্যা ৩ হাজার ৫৬৭টি, অর্থের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সংক্রান্ত রিট মামলা ৫১১টি, জড়িত অর্থ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ১ হাজার ৭৯০টি রিট মামলায় ১১ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় করতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেখানে রায় হওয়ার পরও অর্থ আদায় সম্ভব হয় না। উচ্চ আদালতে রিট মামলা করে স্থগিতাদেশের মাধ্যমে সেই অর্থ বছরের পর বছর আটকে রাখা হচ্ছে। ফলে কিছু কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূলধন সংকটেও পড়ছে।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত গণমাধ্যমকে বলেন, রিট মামলা এমন একটি অস্ত্র যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আটকে দেওয়া সম্ভব। জেনেশুনেই ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট মামলা করে টাকা আটকে দেন। এ ধরনের গ্রাহকরা সাধারণত সমাজের উঁচু স্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা নানা অজুহাতে ও কৌশলে মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি বিলম্বিত করেন। এতে একদিকে যেমন মামলাজট তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে খেলাপি ঋণ যথাসময়ে আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ঋণ আদায় ও ঋণ প্রবাহ দুটোই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেভাবেই হোক খেলাপি ঋণ আদায়ে এই রিট মামলা বন্ধ করতে না পারলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপের দিকে যাবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দেশি-বিদেশি ৬৩টি ব্যাংক ও ২৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে দেশের আর্থিক বাজার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বড়। ফলে একদিকে যেমন খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে তেমনি এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে শুধু হাইকোর্টেই অনিষ্পন্ন রিট মামলার সংখ্যা ৬ হাজারের কাছাকাছি, যাতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটিরও বেশি। বিপুলসংখ্যক এই মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা গেলে খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি ওই অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় শুধু রিট মামলাগুলো নিষ্পন্ন করার জন্য হাই কোর্টে পৃথক বেঞ্চ করার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে আবারও অনুরোধ জানানো হবে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ না করা বা বিলম্বিত করার জন্য বিভিন্ন অজুহাতে হাই কোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করছেন। এ ছাড়া দেশের জেলা পর্যায়ের আদালতের বিভিন্ন প্রকারের মামলায় দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধেও হাই কোর্ট বিভাগে রিভিশন আপিল মামলা দায়ের করা হয়। উপরন্তু খেলাপি গ্রাহকরা এক ব্যাংকে খেলাপি থাকা অবস্থায় অন্য আরেক ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণের সুবিধার্থে খেলাপি ঋণের বিষয়টি যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে সে বিষয়েও আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অর্থঋণ আদালতের বেশির ভাগ রায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আসে। কিন্তু আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে চাতুর্যপূর্ণভাবে রিট দায়ের করছেন। যে কারণে অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর অল্প টাকায় নিয়োজিত প্যানেলভুক্ত অনভিজ্ঞ আইনজীবীর চেয়ে ঋণখেলাপিদের আইনজীবীরা অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এতে উচ্চ আদালতে রিটের শুনানিতে ব্যাংকের পক্ষ যুক্তিতর্কে হেরে যায়। আর এভাবেই উচ্চ আদালতের রিটে আটকে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহীম খালেদ গণমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা আগেই বেশ কিছু সুপারিশ দিয়ে এসেছিলাম। প্রথমত, হাই কোর্টে খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত রিট মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করতে একটি বা দুটো পৃথক বেঞ্চ গঠন করতে হবে। এই বেঞ্চ শুধু খেলাপি ঋণের মামলাগুলোই দেখবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। কারণ বড় আকারের ঋণ আটকে দিতে খেলাপি গ্রাহকরা যে ধরনের আইনজীবী নিয়োগ দেয়, তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংকের নিয়োগৃকত আইনজীবীরা যুক্তি-তর্কে পাল্লা দিতে পারেন না। এ কারণেও স্থগিতাদেশ আটকানো যায় না। বাংলাদেশ প্রতিদিন