দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যেকোনো অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত পর্যায়ে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। সে ক্ষমতার রদ চাইছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচিব কমিটির অনুমোদন পাওয়া সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮-তে এ প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা যেমন ক্ষুণ্ন হবে, তেমনি সাধারণ নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।
সম্প্রতি প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে ‘সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮’ অনুমোদন করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের পর সেখানে এটি অনুমোদন পেলে সংসদে পাঠানো হবে। সংসদে অনুমোদনের পর সেটা আইনে পরিণত হবে। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের আগে সরকার তথা ওই কর্মচারী যে কর্তৃপক্ষের অধীনে কর্মরত, তার অনুমতি নিতে হবে।
১৯৬৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়েও যে–কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৫ ধারায়ও এ বিধান বলবৎ রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী আইনে প্রস্তাব রয়েছে, এই বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আইনটির এ ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। যদি গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হয়, তবে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে একটি উপকমিটি গঠন করা হয় প্রস্তাবিত খসড়া পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। উপকমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেয়। এর ভিত্তিতে সচিব কমিটির বৈঠকে সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন ব্যক্তি গণমাধ্যমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের হাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের হার বেড়ে গেছে। এ থেকে নিস্তার পেতে দুদকের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা কমাতে চাইছেন তাঁরা।
এসব কর্মকর্তার কথার সূত্র ধরে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৩৮৮ জনের মধ্যে ১৬৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়া ১৮২ জনের মধ্যে ৮৪ জন সরকারি কর্মকর্তা। চলতি বছরও দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৫ জনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী। এর বাইরে মামলা হয়েছে দ্বিগুণের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে।
গত দুই বছরে দুদক পরিচালিত ২৯টি ফাঁদে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৯ জন সরকারি কর্মকর্তা। এঁদের বেশির ভাগই সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা। সাম্প্রতিক সময়ে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল হককে ঘুষের পাঁচ লাখ টাকাসহ রাজধানীর একই হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করে দুদক। আগের বছর একই দপ্তরের আরেক প্রধান প্রকৌশলী নিজ দপ্তরেই গ্রেপ্তার হন ঘুষের টাকাসহ।
দুদক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের তালিকায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীও রয়েছেন। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এ তালিকায় নেওয়া হলে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বড় হবে।
দুদক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফাঁদ পেতে দুদক যাঁদের গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের বিষয়ে আগে অনুমতি নিতে হলে আসামি ধরা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এ ছাড়া মামলা বা অনুসন্ধানের প্রয়োজনে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁরা বাইরে থাকলে অভিযোগের আলামত নষ্ট, অনুসন্ধানে প্রভাব বিস্তারসহ নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন। তাই অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তারের বিধান দুদকের ক্ষমতার রাশ টেনে ধরবে।
এ প্রসঙ্গে দুদকের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য আসেনি। জানতে চাইলে দুদক সচিব শামসুল আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারি কর্মচারী আইন নিয়ে কমিশনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রক্রিয়াধীন। তৈরি হলে গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
অন্যদিকে আইনজীবীরা বলছেন, এ বিধান আইনে পরিণত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। দেশের ১৬ কোটি মানুষকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করতে কারও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। কিন্তু মাত্র ১২ লাখ সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে অনুমোদন লাগবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া গণমাধ্যমকে বলেন, এ ধরনের কোনো বিধান আইনত গ্রহণযোগ্য নয়, সংবিধান অনুমোদন করে না। এর মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করা হবে। তিনি আরও বলেন, কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে কি হবে না, তা অপরাধের ওপর নির্ভর করবে। এটি যদি ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে, তাহলে তা মধ্যযুগীয় বা সামন্তবাদী আইন বলতে হবে।
আরেক আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান। তাই গ্রেপ্তার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সবার জন্য একই বিধান থাকবে—এটাই সংবিধানের কথা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ কারণে তাঁদের জন্য বিশেষ বিধান কোনোমতেই হতে পারে না।
২০১৩ সালে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দিতে আরেকটি আইন সংসদে পাস হয়েছিল। দুদক সংশোধন আইনের ৩২(ক) ধারা অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা আছে, যে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না। কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে। এর ফলে কমিশন সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা আমলে নিতে পারছিল না।
সংসদে পাস হওয়া ওই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছিল। রাষ্ট্র বনাম হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের ওই মামলার রায়ে হাইকোর্ট আইনকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে বলা হয়, কোনো একটি দুর্নীতির ঘটনায় সরকারপ্রধান বা মন্ত্রীদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী জড়িত থাকলে সরকারপ্রধান কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে; কিন্তু সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে অনুমতি লাগবে। এই পরিস্থিতির সমন্বয় কীভাবে ঘটানো হবে, এর কোনো দিকনির্দেশনা সংশোধিত দুদক আইনে নেই। আইনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করাটা অযৌক্তিক বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
রায়ে আরও বলা হয়, সংশোধিত এ আইন দেশের সাধারণ মানুষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হবে, যা অসাংবিধানিক।
হাইকোর্ট ওই ধারাটি বাতিল করার পর সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব খন্দকার শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে প্রথম দুর্নীতির মামলা করে দুদক। এ ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নেওয়া হয়নি।
উচ্চ আদালত ওই রায় দেওয়ার পরও ২০১৫ সালে মন্ত্রিসভা সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া অনুমোদন করে, যা হাইকোর্টের রায়ের চেতনার পরিপন্থী বলে মত দেন আইন বিশেষজ্ঞরা। মন্ত্রিসভা আইনটি অনুমোদন দেওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে যে সরকারের মন্ত্রী-সাংসদদের গ্রেপ্তার করতে হলে কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বেলায় তা হবে কেন?
নানা বিতর্কের পর ২০১৬ সালের আগস্টে আইন মন্ত্রণালয় খসড়া আইন পরিবর্তনের পক্ষে মত দেয়। মন্ত্রণালয় দুদক আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির এখতিয়ার বহাল রেখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আইন করার পক্ষে মত দেয়। এরপর থেকে দীর্ঘদিন ওই খসড়া আলোর মুখ দেখেনি।
দীর্ঘদিন পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিতে আইনটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সচিব কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে প্রধান করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত এই উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রথম সভা করে ১৩ ডিসেম্বর। এরপর আরও ৪টি সভা করে ২ এপ্রিল সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করে।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় নব্বইয়ের দশকে। তখন এর নাম ছিল সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট। এ-সংক্রান্ত নানা উদ্যোগের মধ্যে ছিল জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের সহায়তায় প্রকল্প প্রণয়ন, বিদেশ ভ্রমণ এবং বিভাগীয় শহরে সেমিনার আয়োজন। অংশীজনদের সঙ্গেও দিনের পর দিন বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। ২০১১ সালের মার্চে এর খসড়া তৈরি করে তা ওয়েবসাইটে দিয়ে মতামত নেওয়া হয়।
২০১৩ সালে এসে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট নয়, সরকারি কর্মচারী আইন করা হবে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট করলে শুধু ক্যাডার কর্মকর্তারাই অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাই সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া করা হয়।
২০১৩ সালের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এ আইন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। অংশীজনেরা তাঁদের মতামত দিয়েছেন। সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব ওঠার পরও সেটা স্থগিত হয়েছে। ২০১৮ সালে এসে নতুন যে প্রস্তাব করা হচ্ছে তাতেও নতুন করে পুরোনো প্রস্তাবটি রাখা হচ্ছে, যাতে করে সেই বিতর্কই উঠে আসছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সমতা না রেখে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব নতুন করে চলে এসেছে।
আইনজীবী শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য আইন করা জরুরি। কিন্তু তাঁদের জন্য এক রকম এবং রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের জন্য আরেক রকম আইন কাম্য হতে পারে না। আর দুর্নীতিবিরোধী আইনের ক্ষেত্রে সমতা রাখা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, জনগণের করের টাকায় বেতন পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণি তৈরি করা হবে আইনটির মাধ্যমে। এ ধরনের আইন তৈরি হলে শেষ পর্যন্ত সেটা টিকবে না। এ নিয়ে আবারও মামলা হবে। মামলায় সংবিধানবিরোধী এ আইন বাতিল হবে। প্রথম আলো