রাষ্ট্রায়াত্ত বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার তদন্ত আড়াই বছরেরও বেশি সময়ে শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ,উষ্মা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদক আইনজীবীর বক্তব্য শুনে হাইকোর্ট বলেছেন, আপনাদের কথা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ক্ষোভের সঙ্গে বিচারক বলেন, ‘কেন এত কথা বলেছি? আদেশ দিয়ে তো কোনও লাভ হয় না। মনে হয়, উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হয়েছে।’
আজ বুধবার (৩০ মে) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালতে বেসিক ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ফজলুস সোবহানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। এ সময় দুদকের ৫৬ মামলার ৮ তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানির শুরুতেই বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি এবং ব্যাংকটির সাবেক ডিএমডি ফজলুস সোবহানের পক্ষে ১৫টি মামলায় জামিন চেয়ে তার আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ঋণ দেবে, কি দেবে না সেটাতো নির্ধারণ করে বোর্ড। কিন্তু, বলা হচ্ছে ফজলুস সোবহান এতে সহায়তা করেছেন। কী করে তিনি সহায়তা করেছেন? ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটির সব কিছুতে নেতিবাচক মূল্যায়ন থাকার সত্ত্বেও তাকে দায়ী করা হচ্ছে। এই অঙ্কের টাকার ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা এই ভদ্রলোকের ছিল না।
রোকন উদ্দিন মাহমুদের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘কিছুই করার ছিল না! যেন ধোয়া তুলসী পাতা। ঋণ প্রস্তাব বাতিল না করে, শাখার সুপারিশে মর্ডগেজ (বন্ধকনামা চুক্তি) না রেখেই ঋণ অনুমতি দিয়েছেন। সুদে-আসলে ৬৩ কোটি টাকার বেশি উনি আত্মসাত করেছেন।’
খুরশীদ আলম খানের বক্তব্যের মধ্যেই আদালত তাকে বলেন, ‘আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের কোনও দ্বিমত নাই। সবাই লুটপাট করে খেয়েছে। এফআইআর হচ্ছে না কেন, চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? এধরনের মামলায় আড়াই বছর লেগে গেল? তাহলে কেমনে হবে?’
জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমরাতো চেষ্টা করছি। আদালতের প্রত্যেকটা আদেশের পর প্রত্যেক তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বসেছি। তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি নেই।’
তখন আদালত বলেন, ‘আপনি তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিচ্ছেন? ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটির নেতিবাচক সুপারিশ থাকার পর ঋণ দেওয়ার কোনও বিধান নেই। আপনি তদন্ত কর্মকর্তাদের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? নেগেটিভ ফাইন্ডিং থাকার পরও বোর্ড কীভাবে ঋণের অনুমতি দিল? সেই বোর্ডের কাউকে কেন আসামি করা হয়নি?’
দুদক আইনজীবী তখন বলেন, ‘দুদক বসে নেই। চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রত্যেককে। তারপরও কোনো দুর্বলতা আছে কিনা আমরা দেখবো। আজকেই (বুধবার) সকাল ১০টা থেকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি যতটুকু জানি, প্রত্যেকটা বিষয় খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।’
আদালত তখন বলেন, ‘আর কতদিন লাগবে খতিয়ে দেখতে? আড়াই-তিন বছর তো হয়ে গেছে।’
তখন দুদক আইনজীবী জবাবে বলেন, ‘২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত আড়াই বছর হয়েছে। এই সময়ে একটি আদেশ ছাড়া আপনাদের প্রত্যেকটি আদেশ, পর্যবেক্ষণ দুদক পালন করেছে।
আদালত তখন বলেন, ‘গত আড়াই বছরে ৫৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলারও চার্জশিট দিতে পারেননি। লোকবল সংকট থাকলে তো পাঁচটি মামলা দিয়ে তা ভালোভাবে করতেন। ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটি ঋণ অনুমোদন দেয়নি, দিয়েছে বোর্ড। অথচ বোর্ডের কাউকে আসামিই করা হয়নি। বোর্ড সবকিছুর জিম্মাদার?’
আদালত বলে, আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রেও পিক অ্যান্ড চুজ করেছেন। আমাদের এত পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনায় কী হয়েছে? জামিন দিলেও তো সে আদালতের অধীনে থাকবে। একটা লোককে কতবার জিজ্ঞেস করা দরকার? আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা?
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থের উৎস খুঁজে দেখতে দুদক চেয়ারম্যান ও একজন পরিচালকের বক্তব্যের সমালোচনা করে আদালত বলেন, টাকা কোথায় গেল এটা খুঁজে দেখতে হবে কেন? এটা অর্থপাচারের মামলা নয়। এখানে দেখতে হবে অপরাধজনিত কারণে বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে কিনা,অর্থ আত্মসাত হয়েছে কিনা। এ মামলা কোথায় গেল? টাকা কি সিঙ্গাপুর, দুবাই গেছে? এখানে দুর্নীতি হয়েছে কিনা এটাই হল বিষয়। কেয়ামত পর্যন্ত এ অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
আদালত বলেন, ‘এসব কী কথাবার্তা? টাকার উৎস খুঁজে বের করা না পর্যন্ত চার্জশিট দিতে পারবো না, এতেই বোঝা যায় আপনাদের উদ্দেশ্য। এসব কথাবার্তা বলে আপনারা সব শেষ করে দেন। এটা যদি একজন কৃষকের বিরুদ্ধে ৫ হাজার টাকার ঋণের মামলা হতো, তাহলে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে আসা হতো। এদের বেলায় হচ্ছে না কেন?’
দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন দেখেছেন? ‘‘এই বোর্ডের এক সাবেক সদস্যের (এখন সচিব) ‘আমি কারও কাছে জবাবদিহি করবো না’ এমন বক্তব্য পত্রিকায় এসেছে। প্রশ্ন হলো আমরা কি প্রসিকিউশন ও দুদকের দায়িত্ব পালন করবো? এরপর আর কী বলবেন?’’
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান উত্তরে বলন, ‘‘এখন অনেকে সচিব। তাদের অনেকেই আছেন যারা ডাকলেও আসেন না। তারা বলেন, ‘আমরা জবাবদিহি করবো না।’ কেউ কেউ আসতে তারা বাধ্য নন এমন মন্তব্যও করেন।’’
তখন বিচারক বলেন, ‘জবাবদিহি করবো না, বললেই সব হয়ে গেল? আইন নাই? তদন্ত কর্মকর্তাকে সে আইনে ক্ষমতা দেওয়া আছে।’
এ পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘আমরা এখন আর কী বলব। আমরা তো তদন্তকারী কিংবা প্রসিকিউটর হতে পারব না। তবে আপনাদের নির্লিপ্ততার কারণে যেসব আসামি ভেতরে আছে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আপনাদের সখ্যতা আছে বলে মনে হচ্ছে। চার্জশিট দিতে দেরি করছেন, যাতে আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। আমরা তাদের জামিন দিতে বাধ্য হচ্ছি।’
আদালত আরও বলেন, ‘আপনারা অভিযুক্তদের তলবের চিঠি দিতে থাকবেন আর বলবেন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটা কি চলতে থাকবে? আমাদের জানার বিষয় হল, এই যে এতগুলো পর্যবেক্ষণ, আদেশ দিলাম সেগুলো কানে নিলেন না? আমরা চাই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াক।’
এরপর আদালত তলবে আসা তদন্ত কর্মকর্তাদের পক্ষে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের কাছে মামলার অভিযোগ পত্র দিতে বিলম্বের কারণ জানতে চান।
ইকবাল আদালতকে বলেন, ‘গত বছর তদন্ত শেষ করে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিশন থেকে নতুন করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এর মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাও বদল হয়েছে। এরপর বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন বোর্ডের সব সদস্যের বক্তব্য নেওয়া শেষ হয়েছে। তদন্তের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।’
এসময় আদালত বলেন, ‘টাকার উৎস খুঁজতে হবে, এটার প্রয়োজন মনে করেন আপনি? টাকার উৎস বের করা সম্ভব না। ক্যাশ টাকা দিয়ে কেউ জায়গা, কেউ গয়না কিনে ফেলেছে। টাকার এই উৎস অনুসন্ধান সম্ভব না।’
আদালত বলেন, ‘তাহলে দুদক চেয়ারম্যান এবং একজন পরিচালক কিভাবে এ কথা বলেন? আপনাদের এই পারফরম্যান্সে আমরা হতাশ। এখন আমাদের জামিন দিতে হচ্ছে। সব আসামি এক এক করে বের হয়ে যাবে।’
দুদক পরিচালক ইকবাল তখন বলেন, ‘গত পরশু অনেক ডকুমেন্ট এসেছে।’
এ কথা শুনে আদালত বলেন, ‘শিপার আহমেদ বক্তব্য দিয়েছেন? বক্তব্যে কি বলেছেন তা দেখেছেন? আগে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়ে এখন সেখান থেকে শিফ্ট করে আরেক কথা বলছেন। বলছেন, প্রায় শেষ (তদন্ত)। এটা কি আসলেই শেষ? নাকি ছোটো গল্পের মতো শেষ হয়েও হইল না শেষের মতো? পুনরায় আবার আরম্ভ হয়ে যাবে?’
তখন দুদক পরিচালক ইকবাল বলেন, ‘তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তবে এখন পর্যন্ত শেষ বলা যাচ্ছে না।’
আদালত দুদক পরিচালককে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি মনে করেন টাকা আত্মসাত হয়েছে?’
ইকবাল বলন, ‘হ্যাঁ, আত্মসাত হয়েছে।’
তখন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম দুদক পরিচালককে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে ঋণ গ্রহীতাদের গ্রেফতার করছেন না কেন?’
জবাবে সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ঋণ গ্রহীতারা সমানে ঠিকানা পরিবর্তন করে। যে ঠিকানা আমাদের কাছে আছে, সে ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায় না।’
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘বলছেন ঠিকানা পরিবর্তন করে, কিন্তু তাদের তো টকশোতে দেখি। কেউ ব্যবসা করে। কেউ ইটভাটা, কেউ আবার কোল্ড স্টোরেজের। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা যায়। যাই হোক, আমরা তদন্তকারীও না, প্রসিকিউশনও না। রাষ্ট্রের এতগুলো টাকা চলে গেল, এখন সংস্থা (দুদক) যদি কাজ না করে আমাদের তো করার কিছু নাই।’
আদালত আরও বলেন, ‘এরকম একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা দিয়ে যদি কাজ না হয়, তাহলে তো থেকে লাভ নাই। এ নিয়ে কত কথা বললাম! এখন লজ্জায় চোখ ঢাকি। মনে হয় কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকি। আপনাদের কথা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কেন এত কথা বলেছি। আদেশ দিয়ে তো কোনো লাভ হয় না। মনে হয় উলু বনে মুক্তো ছড়ানো হয়েছে।’
এরপর আদালত ফজলুস সোবহানের ছয় মামলায় এবং শিপার আহমেদের এক মামলায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার আদেশের দিন ধার্য করেন।