২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর দক্ষিণখানের সেকেন্দার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি কার্যালয়ে অভিযান চালান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা। কার্যালয়টি জনৈক জাহাঙ্গীর হোসেনের। সেখান থেকে ৫০০ ইয়াবা বড়ি ও তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। গ্রেফতার হয় জাহাঙ্গীরসহ পাঁচজন। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় মামলা করেন ডিএনসির পরিদর্শক একেএম কামরুল ইসলাম। অভিযোগে বলা হয়, জাহাঙ্গীর মাদক ব্যবসায়ী, অপর চারজন তার ইয়াবা ব্যবসার সহযোগী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৪ নম্বর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ এ মামলার রায় দেন। এজাহারে ত্রুটি, জব্দ করা আলামত আদালতে শনাক্ত না হওয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় একজনেরও সাজা হয়নি।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসির উপপরিদর্শক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সঠিকভাবে মামলার চার্জশিট দিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। সাক্ষীরা আদালতে কী বলেছেন, তা জানি না।’ মামলার বাদী একেএম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার রায় হয়েছে কি-না জানি না। মামলার অভিযুক্তরা এলাকার প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হতে রাজি হচ্ছিলেন না কেউ। তার পরও ঘটনাস্থলে ছিলেন, এমন কয়েকজনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আদালতে কি তারা সঠিক সাক্ষ্য দেবেন?’
শুধু এই একটি মামলা নয়, ডিএনসির বেশিরভাগ মাদক মামলায় নানা ত্রুটির কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০ হাজার ৩৪৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন দেশের বিভিন্ন আদালত। এর মধ্যে ৯ হাজার ৯৫২টি মামলার ১১ হাজার ৬৩৪ জন আসামি খালাস পেয়েছে, যা ডিএনসির মোট মামলার ৫২ ভাগ আসামি।
পুলিশের করা মামলার ক্ষেত্রে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় ৬৪ ভাগ আসামি খালাস পেয়েছে। প্রচলিত আইনে মাদকের উপাদান ও পরিমাণ অনুযায়ী মাদক মামলায় সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে। তার পরও মাদকসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে ফিরছে একই ব্যবসায়।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, মামলায় আসামির সাজা হওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষী না থাকলে অপরাধ প্রমাণ হবে কেমন করে? দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদালতে সাক্ষী হাজিরে বাধ্য করতে হবে। তিনি ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি হলে সাক্ষী না আসায় মামলা বিলম্বিত হবে না। তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে সাক্ষী হাজির করা হয় না। এতে মামলা শেষ হয় না। দেরি হয়ে গেলে তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান; সাক্ষী পাওয়া যায় না। এ কারণে আসামি খালাস পেয়ে যায়। বিষয়গুলো দেখা দরকার। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ওপর নজরদারি রাখাও প্রয়োজন।
আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আসামি খালাস হয়ে যাওয়ার মূল কারণ দুটি- প্রথমত, সরকারি কৌঁসুলিদের অস্থায়ী ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ করা হয়। তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা আমলে নেওয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, সরকারের দায়িত্ব সাক্ষী ও আলামত হাজির করা। কিন্তু এখানে চরম ব্যর্থতা আছে। ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার কারণে অপরাধী খালাস পেয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, মাদকের সঙ্গে রাঘববোয়ালরা জড়িত। অনেক ক্ষেত্রে তারা মামলায় প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে এজাহার ও চার্জশিট ঠিকমতো হয় না। অপরাধ কমাতে ও সমাজকে মাদকমুক্ত করতে মাদক মামলার আসামিদের সাজা নিশ্চিত করতেই হবে।
খালাসের নেপথ্যে আট কারণ
ডিএনসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে- মাদক মামলা করা ও তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাবই এর পেছনে প্রধান কারণ। মামলায় সফলতা অর্জনের মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই তাদের।
এ ছাড়া মাদক মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার আটটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
- ত্রুটিপূর্ণ এজাহার দাখিল
- মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া
- জব্দ তালিকায় বর্ণিত স্থানীয় সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল
- জব্দ তালিকায় উল্লিখিত সাক্ষী ও অন্যান্য সাক্ষী আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতা
- উপযুক্ত, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতা
- মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য না দেওয়া
- আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা
- মামলার বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল।
এসব কারণ উল্লেখ করে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরটির মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, আসামি খালাসের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ বছর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সক্ষমতা বাড়াতে কর্মকর্তাদের বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ফৌজদারি অপরাধে মামলার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি এজাহার। সেটা ত্রুটিমুক্ত করতে হবে। মামলার তদন্ত ও জব্দ তালিকা যথাযথভাবে করতে হবে। মতলবি তদন্ত চলবে না। নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকা জরুরি। জব্দ করা দ্রব্য যে মাদক- সেটা প্রমাণ করতে হবে। এসব না থাকলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। আসামিপক্ষকে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। নূ্যনতম সন্দেহ থাকলে আসামি খালাস হয়ে যায়।
সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামলার ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই বাদী, নিজেরাই তদন্ত কর্মকর্তা। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়। এজাহারে সাক্ষীর সঠিক নাম-ঠিকানা থাকে না।
সাত বছরে যত খালাস
২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০ হাজার ৩৪৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেন দেশের বিভিন্ন আদালত। এসব মামলার আসামি ছিল ২২ হাজার ৩৫১ জন। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ১০ হাজার ৭১৭ জনের। ৯ হাজার ৯৫২টি মামলায় ১১ হাজার ৬৩৪ জন আসামি খালাস পেয়েছে, যা মোট মামলার ৫২ শতাংশের বেশি আসামি। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ঢাকার আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ৩২৪টি মামলার মধ্যে ১৯৯টির ২২২ আসামি খালাস পেয়েছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু গণমাধ্যমকে বলেন, মাদক মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নিরপেক্ষ সাক্ষীও থাকতে হবে। অনেক সময় সাক্ষী আসামির পক্ষে চলে যায়। আসামির সাজা নিশ্চিত করতে সাক্ষীসহ মামলা-সংশ্নিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাদী নিজেই সাক্ষ্য দেননি আদালতে
২০১১ সালের ২৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিন নেতার মাজারের পূর্ব পাশ থেকে মাদক ব্যবসায়ী স্বপ্নাকে আটক করে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উপ-অঞ্চলের রমনা সার্কেল। তার দেহ তল্লাশি করে দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়া যায়। সার্কেলের কর্মকর্তা শাহরিয়া শারমিন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় স্বপ্নাকে আসামি করে মামলা করেন। পরে চার্জশিটে সাতজন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছিল। অথচ আদালতে শুধু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন। মামলার বাদীও সাক্ষ্য দেননি। এসব কারণেই গত ১২ নভেম্বর ঢাকা মহানগর ১৪ নম্বর হাকিমের আদালতের রায়ে আসামি খালাস পেয়ে যায়।
সাজা হয়নি জাকিরের
২০১৩ সালের ১৭ মার্চ তেজগাঁওয়ের তেজতুরীবাজার এলাকা থেকে মাদক ব্যবসায়ী জাকির হোসেনকে ২০০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক করে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উপ-অঞ্চলের তেজগাঁও সার্কেল। এ সার্কেলের পরিদর্শক নুসরাত জাহান বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। একই সার্কেলের এসআই মোক্তার উদ্দিন মামলাটি তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেন। জাকির জামিনে বের হয়ে আর আদালতে হাজির হয়নি। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিমের ২৩ নম্বর আদালত এ মামলার রায় দেন। এতে জাকির খালাস পায়। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হয়।
নিরপেক্ষ সাক্ষী ছিল না
২০০৭ সালের ১ মার্চ রাজধানীর কোতোয়ালি থানার নিমতলীর মাজেদ সরদার সড়কে ডিএনসির কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী ইউসুফ আহম্মেদকে তার ভাড়া বাসা থেকে গ্রেফতার করেন। তার বাসা থেকে ৭০০ অ্যাম্পুল নেশা জাতীয় ইনজেকশন টিডিজেসিক বুপ্রেনরফাইন এবং দেড় কেজি গাঁজা জব্দ করা হয়। মাদক বিক্রির আট হাজার টাকাও জব্দ করা হয়। এই মামলার রায়ে আদালত বলেন, জব্দ তালিকার নিরপেক্ষ সাক্ষী সাক্ষ্য দেননি। রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে চিহ্নিত হয়নি। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় ইউসুফ খালাস পেয়ে যায়। সমকাল