ড. বদরুল হাসান কচি:
“বাংলাদেশে দুর্নীতির সংস্কৃতি আগে ছিল না। এটা একটা গোপনীয়তার মধ্যে ছিল। একটু শরমের বিষয় ছিল। এখন পরিস্থিতি এমন যে অনেক সময় ‘বাধ্য হয়ে’ দুর্নীতিতে জড়াতে হয়।” সরকারের অর্থমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে দুর্নীতি নিয়ে এমনই হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। খাঁটি কথা বলেছেন তিনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত বোধহয় কেউ করবেন না। এটাই সত্য, স্বনির্ভর বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান বরাবরই দৃঢ়। তিনি সুযোগ পেলেই তার সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতি না করতে বারবার সতর্ক করেন। গেল বছর জুলাইতে সচিবদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পে-স্কেলে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন যেহারে বেড়েছে, তা বিশ্বে বিরল। তাই জনগণ যেন সেবা পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বেতন যেহেতু বেড়েছে তাই ঘুষ-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।’
এবার আসি মূল আলোচনায়, দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য জানাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)- ১০৬ হটলাইন চালু করেছে। যেকোনো নম্বর থেকে এই হটলাইনে বিনা মূল্যে সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কল করা যায়। একাধিক ব্যক্তি একই সঙ্গে অভিযোগ জানাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হয়।
গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের মতো ফোন আসে এই হটলাইনে। তবে সংস্থাটির তথ্যমতে, হটলাইনে ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিযোগ জানাতে কল বেশি এসেছে। এর মধ্যে দুদকের আওতাবহির্ভূত অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। এসব ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনে তাঁকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওই প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগটি জানিয়ে দেয় দুদক। তবে হটলাইনে তথ্য পেলেই সেটিকে অভিযোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অভিযোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেই অনুসন্ধান চালায় দুদক। অভিযোগ কেন্দ্র থেকে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সেগুলো দুদকের সেলে পাঠানো হয়। সেখানে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অভিযোগটি অনুসন্ধানযোগ্য কি না। কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানযোগ্য হলে ১৫ দিনের মধ্যে অভিযান শুরু করা হয়। তাৎক্ষণিক কোনো দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে সে ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালানো হয়। এ জন্য একজন পরিচালকের নেতৃত্বে দুদকের পৃথক তিনটি দল সর্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। এসব দলের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে পুলিশ সদস্যরা যুক্ত থাকেন।
দুদকের কল সেন্টারে যেসব অভিযোগ জানানো যাবে সে বিষয়ে দুদক থেকে একটা আইনি নির্দেশিকা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণ, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে কেউ ঘুষ নিলে, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ গ্রহণ, আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি করা, নিয়োগ ও বদলিতে দুর্নীতি, সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি, টেন্ডারে দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি, অর্থ পাচার, অবৈধ লেনেদেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য কারো ক্ষতি হওয়া, চাকরির বাইরে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবসা করা, আইন অমান্য বা তাদের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ভুল নথি উপস্থাপনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করা, হুন্ডি ব্যবসাসহ দুর্নীতি সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ দুদকের হটলাইনে জানানো যাবে। যারা অভিযোগ জানাবেন দুদক তাদের পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগটি গ্রহণ করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
গেল বছরের জুলাইতে এ সেবা কার্যক্রম চালু হয়। হটলাইন চালুর এমন উদ্যোগের সবচেয়ে বড় অর্জন জনগণের সঙ্গে দুদকের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। হটলাইনে অনেকের অভিযোগের ভিত্তিতে ওঁত পেতে ঘুষের টাকাসহ অনেক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে দুদক। সেই থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সতর্ক হয়ে গেছে।
দুদকের হটলাইন দুর্নীতি সম্পর্কিত অভিযোগ পাওয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। দুর্নীতিবাজদের বেপরোয়া মনোভাব নিয়ন্ত্রণে দুদকের হটলাইন সফল হলে তা দেশবাসীর জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। দুর্নীতি দমনে গঠিত হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন নামের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দেরিতে হলেও তারা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে দুর্নীতিবাজদের টুঁটি চেপে ধরার যে উদ্যোগ নিচ্ছে তা আশাজাগানিয়া ঘটনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের প্রয়াস সফল হোক এ কামনা দেশবাসীর।
লেখক: আইনজীবী এবং সদস্য, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।