লালসালু মোড়ানো এজলাস, কালো গাউন বা আলখেল্লা ও সাদা শার্ট ও টাই পরা বিচারক এবং আইনজীবী, অস্ত্র হাতে পোশাক পরা পুলিশ—সবই যেন ভীতিকর। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নির্বিশেষে সব আসামিকেই এমন পরিবেশে আদালতে হাজির করা হয়ে থাকে। মামলায় জড়িত হলেই এ ধরনের পরিবেশ দেখাতে অভ্যস্ত সবাই।
তবে এ চিরাচরিত সাধারণ নিয়ম পাল্টে শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে শিশুবান্ধব আদালত। যেখানে থাকবে না সাধারণ আদালতের মতো লালসালু মোড়ানো এজলাস, পোশাক ও অস্ত্রধারী পুলিশ, ডক ও কাঠগড়া, গাউন পরা বিচারক ও আইনজীবী। আদালত কক্ষের পরিবেশই হবে অনেকটা ঘরোয়া ও পারিবারিক। শিশুদের জন্য থাকবে বিভিন্ন ধরনের খেলনা, বেলুন, বিভিন্ন ধরনের চকলেট, বিস্কুট ও বসার জায়গা। অভিভাবকদের উপস্থিতি থাকবে ঘরোয়া পরিবেশের মতো। কোনো মামলায় আসামি বা সাক্ষী হিসেবে শিশুদের মানসিক চাপমুক্ত রাখতে ২০১৩ সালের শিশু আইনের বাস্তবায়ন করছে সরকার। সারা দেশে এ ধরনের ১৫টি আদালতের কার্যক্রম চলছে। শিগগিরই এসব আদালতের উদ্বোধন করা হবে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, আদালতকে ভীতিমুক্ত এবং শিশু আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে সরকার। সেই হিসেবে ২০১৭ সালেল ১৪ ফেব্রুয়ারি শিশু অধিকার বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কমিটি এবং ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল) বাংলাদেশ একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশু আদালত হিসেবে নির্ধারিত আদালত কক্ষগুলোকে শিশু আইনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলা। আইনের আওতায় আসা শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিশু আইন অনুযায়ী ব্যতিক্রমভাবে সাজানো হচ্ছে শিশু আদালতের কক্ষ। এ সমঝোতা স্মারকের আওতায় প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকা মহানগর ও জেলায় দুটি, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলায় দুটি, খুলনা মহানগর ও জেলায় দুটি, সিলেট মহানগর ও জেলায় দুটি, রাজশাহী মহানগরী ও জেলা দুটি এবং রংপুর বিভাগে একটি, ময়মনসিংহ জেলায় একটি, যশোর জেলায় একটি, কক্সবাজার ও বরিশাল জেলায় একটি করে শিশুবান্ধব আদালত কক্ষ তৈরি হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, নির্ধারিত এসব আদালতে বিচারকার্য চলাকালে উকিল ও বিচারকের গায়ে থাকবে না নির্ধারিত গাউন। পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারীও পেশাগত বা দাপ্তরিক কোনো পোশাক পরতে পারবে না। আদালতকক্ষের পাশেই থাকবে একটি ওয়েটিং রুম (অপেক্ষমাণ কক্ষ)। এ ছাড়া থাকবে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার কক্ষ। ওয়েটিং রুম ও প্রবেশন কর্মকর্তার কক্ষ সাজানো হচ্ছে বিভিন্ন চিত্রকর্ম দিয়ে। অভিযুক্ত শিশুরা সার্বক্ষণিক প্রবেশন কর্মকর্তার সান্নিধ্য ও সহায়তা পাবে। বিচারকাজ শুরুর আগে শিশু তার বাবা-মা বা অন্য অভিভাবকের সান্নিধ্যে অপেক্ষা করতে পারবে। ফলে অন্যান্য আদালতে আনীত বয়স্ক অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে এসব শিশুর সংমিশ্রণের সুযোগ থাকবে না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, শিশু আইনের বিধান অনুযায়ী শিশুবান্ধব শিশু আদালত গড়ে তোলা হচ্ছে। এ কাজের জন্য শিশু অধিকার বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলীসহ কমিটির অন্য সদস্যরা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে পরিদর্শন করে পুলিশ, সমাজসেবা কর্মকর্তা, বিচারকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ সভা করেছেন। শিশু আইনের বিধান মেনে কীভাবে শিশু আদালতের পরিবেশ শিশুবান্ধব করা যায়, সে ব্যাপারে তারা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কার কী দায়িত্ব হবে, কীভাবে আইনের আওতায় আসা শিশুদের শিশুবান্ধব পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিচার সম্পন্ন করা যাবে, শিশু আইন অনুযায়ী আদালত কক্ষগুলো কেমন হবে এসব বিষয়ে তারাই দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাদের নির্দেশনার আলোকেই মোট ১৫টি আদালত শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে। খুব শিগগিরই ঢাকা ও চট্টগ্রামের আদালত কক্ষগুলোর উদ্বোধন করা হবে।
শিশু আইনে দেখা যায়, ২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৬(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিটি জেলা সদরে এবং ক্ষেত্রমতো মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে একটি করে শিশু আদালত থাকবে। এক বা একাধিক অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালতকে শিশু আদালত হিসেবে নির্ধারণ করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে।
আইনের ১৭(১) ধারা অনুযায়ী আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু বা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু কোনো মামলায় জড়িত থাকলে যেকোনো আইনের অধীনেই হোক না কেন, ওই মামলা বিচারের এখতিয়ার থাকবে কেবল শিশু আদালতের।
১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, সাধারণত যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, সেটা ব্যতীত, যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
শিশু আদালতের কার্যক্রম নিয়ে মনিটরিং করা সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৩ সালে আইন তৈরি হলেও এর বিধি বিধানগুলো সেভাবে মানা হচ্ছিল না। শিশু আইনের বাস্তবায়ন করতেই মূলত এ আইন করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৩ সালের শিশু আইনটি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই ব্যতিক্রমধর্মী আদালতকক্ষ গড়ে তোলা হচ্ছে। আইনেই বলে দেওয়া আছে শিশু আদালতের পরিবেশ কেমন হবে, বিচারক, পুলিশ, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিশিয়াল ড্রেস পরতে পারবে না। কিন্তু এগুলো প্রতিপালন হচ্ছিল না। ইউনিসেফের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এনটিভি অনলাইন