ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:
লর্ড কার্লাইল একজন ব্রিটিশ আইনজীবী এবং যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলাসমূহের জন্য নিযুক্ত আইনজীবী। তবে তার আরো বড় পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের তথা জামায়াতে ইসলামীর পক্ষের একজন অন্যতম প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক লবিস্ট। লর্ড কার্লাইলকে ভারত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি দিল্লি বিমানবন্দর থেকেই বিতাড়িত করেছে, ভারতে প্রবেশ করতে দেয়নি।
যদিও তার কাছে ভারতে প্রবেশের জন্যই ভিসা ছিল কিন্তু লর্ড কার্লাইল বিমান থেকে ভারতের দিল্লিতে অবতরণের পূর্বেই ভারত সরকার তার সেই ভিসা বাতিল করে দেয়। ফলে বিমানবন্দর থেকেই লর্ড কার্লাইলকে ভারত ত্যাগ করতে হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার জানিয়েছেন, কেন লর্ড কার্লাইলকে ভারতে ঢুকতে দেয়া হয়নি তার সহজ উত্তরটা হলো- লর্ড কার্লাইলের কাছে সঠিক বৈধ ভিসা ছিল না। তার ভিসার আবেদনপত্রেও অসঙ্গতি ছিল। ঐ ফর্মে যে কথা লেখা ছিল, আর তার সফরের আসল উদ্দেশ্য মোটেও এক ছিল না; তিনি আসলে কী জন্য ভারতে আসছেন, সেটা প্রথম থেকেই ছিল একেবারে পরিষ্কার।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, লর্ড কার্লাইল তার ভিসার আবেদনে ভারতে সফরের উদ্দেশ্য কী লিখেছিলেন এবং প্রকৃত পক্ষে তার ভারত সফরের উদ্দেশ্য কী ছিল? লর্ড কার্লাইলের ভারত সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে চলমান বিচারিক মামলাসমূহের বিরুদ্ধে ভারতীয় সুধী সমাজের মধ্যে এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করার উদ্দেশ্যে প্রেস কনফারেন্স করা। অথচ তিনি তারই-ভিসা আবেদনে সে কথা উল্লেখ না করে বরং ব্যবসায়িক কারণ উল্লেখ করেছেন।
একজন ব্রিটিশ নাগরিক লর্ড কার্লাইল যুক্তরাজ্য থেকে এসে ভারত ভ্রমণে বাধার শিকার হতেই পারেন। ব্যাপারটি নিতান্তই যুক্তরাজ্যের একজন নাগরিক এবং ভারতীয় ইমিগ্রেশনের ব্যাপার হতেই পারত। কিন্তু ভ্রমণের উদ্দেশ্য যখন হয় ভারতকে ব্যবহার করে তৃতীয় একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা, তখন বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করে বৈকি।
লর্ড কার্লাইল একজন প্রবীণ আইনজীবী এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগার সেই যুক্তরাজ্যের একজন সম্মানিত সাংসদ। বিএনপি তথ্য সূত্রে যতটকু জানা যায় যে, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় সহযোগিতা করার জন্য তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেখানে খালেদা জিয়ার মামলাসমূহ চলছে বাংলাদেশের আদালতে, মামলাসমূহের পক্ষদ্বয় বাংলাদেশি, মামলাসমূহের বিচারকগণ বাংলাদেশি নাগরিক, মামলাসমূহের বিষয় বাংলাদেশ ঘিরে, সেখানে লর্ড কার্লাইল ভারতের মাটিতে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ জাহাজ কেন নোঙর করতে চাইলেন সেটা ঠিক বুঝলাম না!
বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলার ব্যাপারে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের কিছু বলার এখতিয়ার নেই। এটাই আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক প্রথা। কেননা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা মোটেও আন্তর্জাতিক আইনসিদ্ধ নয়। এটা লর্ড কার্লাইলের মতো প্রবীণ আইনজীবীর পক্ষে অজানা থাকার কথা নয়। তাহলে কেন হঠাৎ ভারতে এসে ভারতের জনগণের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলার বিষয়ে খোশগল্প করতে চাইলেন লর্ড কার্লাইল? বিএনপি তাকে ঠিক কী কারণে নিয়োগ দিয়েছে তা আমার একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি কি খালেদা জিয়ার পক্ষে লবিস্টের কাজ করার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন? নাকি তিনি সুদূর দিল্লি থেকে ‘কারাগারের তালা ভাঙব, খালেদা জিয়াকে আনব’ স্লোগান দিতে দিতে এক মোর্চা নিয়ে ভারতকে সংগঠিত করে বাংলাদেশ আক্রমণের রণকৌশল তৈরি করতে গিয়েছিলেন ভারতে? হাস্যকর!
লর্ড কার্লাইল যদি তার ভারত সফরের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হতেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারত। তার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটা ত্রিমাত্রিক বিরোধের সৃষ্টি করা। প্রথমত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দিতে পারত। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ হিসেবে ব্যাপারটিকে নিতে পারতাম। আমাদের আদালতে চলমান মামলা নিয়ে ভারতের মাটিতে অসৎ উদ্দেশ্যমূলক আলাপ-আলোচনা আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে অযথা জটিলতা দেখা দিতে পারত।
পরের ব্যাপারটি হলো, লর্ড কার্লাইলের ব্যক্তিগত অবস্থান। তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম আইন প্রণয়নকারী এবং বিচারিক অঙ্গ House of Lords এর একজন সদস্য। সুতরাং লর্ড কার্লাইলের কর্মকাণ্ডের দায়ভার যুক্তরাজ্য রাষ্ট্রের ওপরই বর্তাবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্রের কিছু আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা রয়েছে।United Nations Charter-এর Article 2(4) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে Principle of Non-Intervention-এর অবতারণা করেছে। এর অর্থ হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালত International Court of Justice এর অসংখ্য মামলা প্রণিধানযোগ্য। যেমন: Nicaraguan Case (১৯৪৬), Corfu Channel Case (১৯৪৯), DRC vs. Uganda (২০০৫) ইত্যাদি। সুতরাং লর্ড কার্লাইল যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন তা সফল হলে লন্ডন-দিল্লি সম্পর্ক এবং লন্ডন-ঢাকা সম্পর্ক দুটোরই অবনতি হতো।
ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি নিজে নির্দিষ্ট করে। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কী ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ভারতের অভ্যন্তরীণ এখতিয়ারের বিষয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিসীমা নির্ধারণের বিষয়টি তাই একান্তভাবেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। লর্ড কার্লাইল সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের মতো ভারতে পৌঁছে যদি বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার জয় নিশ্চিত করার দুঃসাহস দেখান, তবে তা অবশ্যই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ওপরে অযাচিত নাকগলানো হবে বৈকি। সে ক্ষেত্রে লন্ডন-দিল্লি সম্পর্কের অবনতি অনিবার্য।
আবার একই রকমভাবে লর্ড কার্লাইল যদি ভাবেন যে বাংলাদেশের আদালতে চলমান মামলা নিয়ে সেই আদ্যিকালের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের মতো তিনি অযাচিত মাতব্বরি করবেন, তবে তো তা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপেরই নামান্তর। এক্ষেত্রে ঢাকা-লন্ডন সম্পর্কেরও অবনতি অনিবার্য। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, লর্ড কার্লাইলের কূটচাল ছিল যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ত্রিমাত্রিক বিরোধের সৃষ্টি করা।
শেষ করতে চাই একটি মজার পর্যবেক্ষণ দিয়ে। ভারত-বিতাড়িত লর্ড কার্লাইল বিএনপির অফিসিয়াল ওয়েবপেজে (en.bnpbangladesh.com) সম্প্রতি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী দলটির কখনো প্রতিনিধিত্ব করেননি বা তাদের হয়ে বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লবিস্ট হিসেবে কখনো কাজ করেননি। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তোলে তবে তা মানহানিকর বলে বিবেচ্য হবে। তিনি প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করবেন না। মোদ্দাকথা হলো, বিএনপির ওয়েব পেজে লর্ড কার্লাইলের এই গর্জন প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে লর্ড কার্লাইলের কোনো সম্পর্ক ছিল না বা থাকতে পারে না।
এবার বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর অফিসিয়াল ওয়েবপেজে (jamat-e-islami.org) গেলে আমরা দেখতে পাব যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী নেতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় ২০১৬ সালের ১১ মার্চ তারিখে লর্ড কার্লাইল আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে এক হৃদয়বিদারক (!) আইনি অভিমত লিখে পাঠিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীকে। আচ্ছা, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যদি লর্ড কার্লাইলের কোনো সম্পর্কই না থাকে, তবে তাদের সঙ্গে এই চিঠি চালাচালি কি এমনি এমনিই? বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার ব্যবস্থাকে কট্টরভাবে সমালোচনা করে লেখা চিঠিটি যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেমের রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানোর মানে কী? লক্ষ্য করবেন চিঠিটির প্রথম লাইনেই। লেখা আছে- From, The Lord Carlile, of Berriew QC CBE.
জামায়াত-বিএনপি যেমন একই বৃন্তে দুটি ফুল, ঠিক তেমনি ফুল গাছটির অন্যতম কুচক্রী মালি একজন লর্ড কার্লাইল। ভারতের মাটিতে বসে ত্রিমাত্রিক ষড়যন্ত্রের যে কূটচাল লর্ড কার্লাইল সাজিয়েছিলেন তা বানচাল করে দেয়ার জন্য ভারতকে সাধুবাদ! –
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।