চট্টগ্রামে ৭ উপজেলার ২১ ‘চৌকি আদালতের’ বেহাল দশা

চট্টগ্রামের সাত উপজেলায় রয়েছে ২১টি চৌকি আদালত। এই সব আদালতে জেলার ১২টি থানার ৫০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন আছে। পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া ও সন্দ্বীপে অবস্থিত এই সব চৌকি আদালত। ভবন, আবাসন, যানবাহন, লোকবল, আসবাবপত্র সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব আদালত। অধিকাংশ আদালতের কোনটি বাঁশের বেড়া টিনের ঘরে, কোনটি টিন শেড সেমি পাকা মরচে ধরা ও জরাজীর্ণ দালানে চলছে বিচার কাজ। বাঁশখালী, সন্দ্বীপ ও রাঙ্গুনিয়ার চৌকি আদালতে কর্মরত বিচারকদের নিজস্ব কোন বাসভবন নেই। পটিয়া, সাতকানিয়া, রাউজান, ফটিকছড়িতে কর্মরত বিচারকদের জন্য থাকা বাসভবনগুলোও পরিত্যক্ত। নেই কোন নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।

অন্যদিকে জেলার এই ২১টি চৌকি আদালতে ২৫০টির মতো বিচার বিভাগীয় কর্মচারীর পদ রয়েছে। দীর্ঘ দিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের পদ শূন্য রয়েছে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি। ২১টি চৌকি আদালতের মধ্যে বিচারক নেই ৫টি আদালতের। ফলে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাশাপাশি চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের। দিনে দিনে মামলা জট বাড়ছে, বাড়ছে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা।

জানা যায়, চট্টগ্রামের পটিয়ার যে ভবনে ‘চৌকি আদালতের’ কার্যক্রম চলছে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১৯৮৫ সালে। এরপরও এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ছোট ছোট কামরায় বসে কাজ করছেন বিচারকরা। প্রায় দেড়শত বছর আগে ব্রিটিশদের নির্মিত টিন শেড আর বাঁশের বেড়ার মরচেধরা এ জরাজীর্ণ ভবন। এজলাস কক্ষে বৃষ্টির পানি পড়ে এবং সূর্যের আলো ঢুকে পড়ে। সামান্য বৃষ্টিতে নষ্ট হয় অনেক মূল্যবান রেকর্ডপত্র। আদালতের চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় ঝুঁকির মধ্যে আছেন বিচারকরা।

পটিয়া চৌকি আদালতে একটি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, তিনটি সিনিয়র সহকারী জজ ও তিনটি সহকারী জজ আদালত রয়েছে। এর বাইরে জুডিসিয়াল হাকিমের আদালত রয়েছে একটি। প্রায় ২৩ হাজার মামলা বিচারাধীন এই আটটি আদালতের মধ্যে বিচারক শূন্য রয়েছে তিনটি। যে পাঁচজন বিচারক দায়িত্ব পালন করছেন পটিয়া চৌকি আদালতে, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাসকামরা ও আবাসন ব্যবস্থারও অভাব রয়েছে। বিচারকদের ব্যবহারের জন্য নেই কোনো যানবাহন। বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি শৌচাগারও নেই। সীমানা প্রাচীর না থাকায় আদালতের জমি দখলের অপচেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ আছে।

এই প্রসঙ্গে পটিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট কামাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৮৮২ সালে পটিয়া চৌকি আদালত তৈরি হয়। শতবর্ষী জরাজীর্ণ পটিয়া চৌকি আদালত ভবনের জায়গায় একটি নতুন ভবন নির্মাণ করার দাবি জানিয়ে বহু বছর থেকে আমরা সরকারের কাছে ধর্না দিচ্ছি। ২০১০ সালে ২০ কোটি টাকায় ৬ তলা ভবন নির্মাণের একটি প্রস্তাব যায় মন্ত্রণালয়ে। পরে সেটি ১০ কোটি টাকায় তিন তলা ভবন নির্মাণ হওয়ার প্রস্তাব পাশ হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। কিন্তু ভবন হচ্ছে, হবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এখনো। কখন হবে সেটি আমরা জানিনা। তবে নতুন ভবন নির্মাণ করার জন্য বর্তমান আদালত সরিয়ে নিতে একটি অস্থায়ী টিনশেড নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু এই ছোট অস্থায়ী টিনশেডে আটটি আদালতের জায়গা কোনভাবেই হবে না। ফলে দুর্ভোগ আরো চরম আকার ধারণ করবে।

বিচারকদের বাস ভবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারকদের বর্তমান বাসভবন গুলো পরিত্যক্ত। সেখানে বসবাস করার কোন সুযোগ নেই। বিচারকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। আদালতের ভবনের পাশাপাশি বিচারকদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।

১৮৮০ সালে সাতকানিয়া আদালত প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে ১৮৮৪ সালে সাতকানিয়ায় আদালত ভবন নির্মিত হয়। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার মামলার বিচারকাজ এ আদালতে হয়ে আসছে। বৃটিশ আমলে নির্মিত আদালত ভবন এখন জরাজীর্ণ, বর্ষাকালে পানিতে ডুবে থাকে এবং বিচারকদের জরাজীর্ণ বাসভবনটি বর্তমানে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিচারকরা বসবাস করেন। সাতকানিয়া চৌকি আদালতে একটি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, একটি সিনিয়র সহকারী জজ ও দুইটি সহকারী জজ আদালত রয়েছে। চারটি আদালতের মধ্যে একটি সহকারী জজ আদালতে বিচারক নেই। এই চারটি আদালতে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া থানার ১০,৪৫৩টি দেওয়ানী মামলাসহ প্রায় একহাজার ফৌজদারী মামলা বিচারাধীন আছে।

সাতকানিয়া আদালতের আইনজীবী এডভোকেট ঠাকুর চাঁদ নন্দী বলেন, স্বাধীনতার এতবছর পরও এমন জরাজীর্ণ আদালত ভবন মানা যায় না। নতুন করে আদালত ভবন ও বিচারকদের বাসভবন নির্মাণ করা খুবই জরুরি। ভবন ও আবাসন সুবিধা না থাকায় এখানে কোন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্মচারী বেশি দিন থাকতে চান না। দ্রুত বদলি হয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এদিকে ১৯৮০ সাল থেকেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ফটিকছড়ি সিনিয়র সহকারী জজের বাসভবনটি। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও সংস্কার করা হয়নি বাসাটি। পরিত্যক্ত বাসভবনটি এখন নড়বড়ে। প্রধান ফটক, মূল ভবনের বেহাল দশা। ভেঙে পড়েছে দরজা–জানালা। দেয়ালজুড়ে উঠেছে বিশাল আকৃতির বট গাছ। বিদ্যুৎ সংযোগ ও বৈদ্যুতিক বাতির অস্তিত্ব নেই। নির্ধারিত বাসভবনের অভাবে ফটিকছড়ি চৌকি আদালতের সিনিয়র সহকারী জজকে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ আছে। ৪০৪৯টি মামলা বিচারাধীন আছে ফটিকছড়ি উপজেলার এই চৌকি আদালতে।

ফটিকছড়ি আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট মো. আলাউদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে মহকুমা সদর ফটিকছড়িতে স্থাপন করা হয় একটি চৌকি আদালত। ১৯৮৯ সালের ১৯ মার্চ এ আদালতকে মুন্সেফ কোর্টে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে মুন্সেফ আদালতটি পরিণত হয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে। ১৯৮৫ সালে এরশাদের আমলে তৈরি হওয়া একটি এক তলা ভবনে চলছে বিচারিক কাজ। তবে সীমানা প্রাচীর না থাকায় নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। তিনি আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আদালত ভবনের কাছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তায় বিচারকের বাসভবন থাকার কথা। সে হিসেবে ফটিকছড়ি আদালত ভবনের পেছনেই এর অবস্থান। তবে দীর্ঘ সময় সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকায় এটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী।

জেলার রাউজান উপজেলায় চৌকি আদালত রয়েছে একটি। সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের একটি চৌকি আদালতে বর্তমানে কোন বিচারক নেই। মামলা বিচারাধীন আছে ২৪০০টি। বিচারকের জন্য থাকা বাসাটি পরিত্যক্ত হয়েছে অনেক বছর আগে। ফলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয় বিচারককে।

দ্বীপ অঞ্চল সন্দ্বীপে চৌকি আদালত রয়েছে দুটি। একটি সিনিয়র সহকারী জজ ও অন্যটি জুডিসিয়াল হাকিমের আদালত। এই দুটি আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে ৮৫৬টি। এক তলা পাকা ভবনে চলে বিচারিক কার্যক্রম। বিচারকদের জন্য কোন নিজস্ব ভবন নেই। ফলে উপজেলা প্রশাসনের একটি ডরমেটরীতে থাকতে হয় চৌকি আদালতে বিচারকদের।

জেলার বাঁশখালীতে চারটি চৌকি আদালত রয়েছে। ৪,৪৬৮টি মামলা বিচারাধীন আছে এই চারটি আদালতে। নির্মাণাধীন আছে আদালতের নতুন ভবন। তবে অস্থায়ী ভবনে চলছে বিচারিক কাজ। নেই কোন বিচারকের নিজস্ব ভবন কিংবা যানবাহন সুবিধা। ফলে ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব পালন করছেন এই সব চৌকি আদালতের বিচারকগণ।

রাঙ্গুনিয়ায় চৌকি আদালত রয়েছে একটি। সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের এই চৌকি আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে ২,২৪২টি। বিচারকের কোন নিজস্ব বাসভবন নেই। যানবাহনও নেই।

চট্টগ্রাম জজশীপ কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ও বেঞ্চ সহকারী মো. সাইফুদ্দিন পারভেজ বলেন, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর মানুষকে আইনি সেবা দেওয়ার জন্য চৌকি আদালতগুলো স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ২১টি চৌকি আদালতে ২৫০টিবিচার বিভাগীয় কর্মচারীর পদ রয়েছে। তবে দীর্ঘ দিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের পদ শূন্য রয়েছে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি। সূত্র: আজাদী