চট্টগ্রামে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক মামলার দুই আসামির জাল জামিন আদেশ তৈরির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করেছে এ বিষয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওই কমিটির প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী, সংশ্লিষ্ট ডেপোনেন্ট ও অন্যান্য ব্যক্তিকেও দায়ী করা হয়েছে।
এদিকে ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে একটি চক্র হাইকোর্টের নামে ভুয়া জামিন আদেশ দাখিল করে ওই দুই মাদক ব্যবসায়ীকে মুক্ত করে। এই ‘চুক্তি’ হয় জেলে বসেই। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর হাইকোর্টের নির্দেশে মো. রাসেলকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নগরীর মিয়াখাননগর থেকে গ্রেপ্তার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। আহমেদ নূর এখনো পলাতক।
এ ঘটনায় দায়ী ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন- ফৌজদারি বিবিধ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম সুলতানা, ওই শাখার সুপারিনটেনডেন্ট (তত্ত্বাবধায়ক) মো. মুজিবুর রহমান, রশরঞ্জন মণ্ডল ও মো. জামাল উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আ. বাসেদ ও মৌসুমী দেব, মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারী মো. মজিবুর রহমান, মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারী মো. মনিরুজ্জামান মনি ও এমএলএসএস মঞ্জু রাণী কৈরী।
এই ১০ জনের মধ্যে এমএলএসএস মঞ্জু রাণী কৈরীকে জালিয়াতিপূর্ণ জামিনাদেশ প্রস্তুতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, নিজ দায়িত্বের বাইরে গিয়ে আ. বাসেদের টেবিলে রক্ষিত রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রি করা এবং মামলার নথি শাখায় না থাকার জন্য দায়িত্বে অবহেলা, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অসদাচরণের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
মঞ্জু রাণী কৈরীর তদবিরের অংশ হিসেবে তার কাছ থেকে টাইপ করা বাবদ বেআইনিভাবে টাকা গ্রহণ করায় অফিস সহকারী মো. মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অসদাচরণের জন্য দায়ী করা হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা আ. বাসেদকে দায়িত্বে অবহেলা, শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ অসদাচরণের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকিদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
১০ জনকে দায়ী করার পাশাপাশি জালিয়াতি রোধে ১৩ দফা সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদনটি বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে ওই বেঞ্চের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গতকাল বলেন, ‘আমরা তদন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েছি। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে শুনানি হবে।’
জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আহম্মেদ নুর ও মো. রাসেলকে চট্টগ্রামের সদরঘাট থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৮ আগস্ট এ ঘটনায় মামলা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা আদালত ৩-এ মামলাটির বিচার চলছে। এ অবস্থায় এই দুই আসামি গত ৮ এপ্রিল বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ থেকে জামিন পান মর্মে এক জাল জামিন আদেশ বিচারিক আদালতে পৌঁছে।
তবে জামিন আদেশটি জাল হলেও নিম্ন আদালতে যেভাবে পৌঁছে তাতে এটি জাল বোঝার কোনো উপায় ছিল না। জামিন আদেশের কপিটি ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে প্রস্তুত করে তা হাইকোর্টের আইটি শাখায় পাঠানো হয়। আইটি শাখা থেকে অনলাইনে বেইল কনফারমেশন নম্বর পড়ে। আসামি জামিন পেয়েছে কিনা, তা এই অনলাইন নম্বর থেকেই নিম্ন আদালতও নিশ্চিত হয়ে থাকে। এর পর আসামিরা নিম্ন আদালতের মাধ্যমে জামিনে কারামুক্তি পান।
এত বিপুল অঙ্কের ইয়াবা আটকের মামলায় দুই আসামির জামিন পাওয়ার ঘটনায় সন্দেহ জন্ম দেখা দিলে চট্টগ্রামের আইনজীবীরা বিষয়টি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জানান। সরকারের এই আইন কর্মকর্তা পরে বিষয়টি হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের নজরে আনেন। গত ৩০ মে হাইকোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এই জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বের করতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। পরে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারকে চেয়ারম্যান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
ওই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে সাক্ষ্য পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, আদালতের গত ৮ এপ্রিলের কার্যতালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোশন পিটিশনটি (জামিন আবেদনটি) কার্যতালিকাভুক্ত নেই। যেহেতু মোশন মামলাটির শুনানি হয়নি, কাজেই ওই আদালতের বিচারপতিদের ওই জাল জামিন আদেশে স্বাক্ষর করারও কোনো সুযোগ নেই। ওই আদালত থেকে দুটি পিয়ন বুকের মাধ্যমে মোশন মামলাগওলো ফৌজদারি বিবিধ শাখায় পাঠানো হয়। কিন্তু ৮ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আহম্মেদ নূর নামের কোনো মোশন পিটিশন ফৌজদারি বিবিধ শাখায় পাঠানো হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফাইলিং শাখা থেকে জব্দ করা রেজিস্ট্রার পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি আহম্মেদ নূর গং নামের মোশন দরখাস্ত গত ৫ এপ্রিল এন্ট্রি হয়, যার টেন্ডার নম্বর-১৯৮৮১। রেজিস্ট্রার খাতায় আইনজীবী হিসেবে শফিকুল আলমের নাম এন্ট্রি রয়েছে। কিন্তু আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ নেই। ওই দিনেই মোশন পিটিশনটি এফিডেভিট কমিশনারের সামনে উপস্থাপন করে এফিডেভিট করা হয়েছে। রেজিস্ট্রার খাতায় ডেপোনেন্ট হিসেবে আরিফের নাম এন্ট্রি করা হয়েছে। কিন্তু তার ব্যাপারে অন্য কোনো তথ্য উল্লেখ না থাকায় তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অফিস সহকারী মো. মনিরুজ্জামান মনি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, গত ১০ এপ্রিল এমএলএসএস মঞ্জু রাণী কৈরী এই মোশন মামলার কাগজ নিজ হাতে নিয়ে এসে নাম্বারিং এন্ট্রি করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি মামলার নম্বর ফেলেন। মোশন নাম্বারিং এন্ট্রি রেজিস্ট্রার পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাতে এই মামলার ১৭১৫৭/১৮ নম্বর দেওয়া হয়েছে এবং আইনজীবী হিসেবে ড. রফিকুর রহমানের নাম এন্ট্রি রয়েছে।
এর পর প্রত্যেকেই তাদের জবানবন্দিতে মঞ্জু রাণীর মাধ্যমে নথি পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। মঞ্জু রাণী কৈরী তার জবানবন্দিতে স্বীকার করে বলেছেন, প্রথম জজ ফাইল, দ্বিতীয় জজ ফাইল, জামিন আদেশের কপিসহ পুরো ফাইল গত ১০ এপ্রিল শাখার ভেতরে একটি ছেলে তাকে ৩০০ টাকা দিয়ে কাজটি করে দিতে বললে তিনি নাম্বারিং এন্ট্রি করার জন্য মনিরুজ্জামান মনিকে দেন।
এদিকে জেলে থাকাকালে একটি চক্রের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই দুই ইয়াবা কারবারীর। ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে চক্রটি হাইকোর্টের নামে ভুয়া জামিন আদেশ দাখিল করে ওই দুই মাদক ব্যবসায়ীকে মুক্ত করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর হাইকোর্টের নির্দেশে মো. রাসেলকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নগরীর মিয়াখাননগর থেকে গ্রেপ্তার করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ। আহমেদ নূর এখনো পলাতক।
২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে নূর ও রাসেল। পরদিন সদরঘাট থানায় আরও চার সহযোগীসহ তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বলেন, রাসেল ও নূর ওই মামলায় ২০ মাস জেলে ছিল। জেলে থাকাকালে তাদের সঙ্গে একটি চক্রের পরিচয় হয়। ওই চক্রের সদস্যরা তাদের জামিন করিয়ে দেওয়ার জন্য ১৭ লাখ টাকার চুক্তি করে। সূত্র: আমাদের সময়