আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার সুযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে দৌরাত্ম্য বেড়েছে বহিরাগতদের। আদালত পাড়ায় ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত এসব বহিরাগত মামলার রায় কিংবা জামিনাদেশ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে এলেই কেবল এর বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। অন্যথায় থেমে থেমে ঠিকই চলছে চক্রটির অপরাধ কার্যক্রম। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি মাদক মামলার আসামির জামিন পাওয়ার ঘটনায় করা সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিচারাঙ্গনে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র বলছে, ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট আহমেদ নূর ও মো. রাসেল নামের দুই ব্যক্তিকে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র্যাব। পরে এ ঘটনায় এই দুই আসামিসহ মোট চারজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সদরঘাট থানা পুলিশ মামলা করে। পরদিন (১৮ আগস্ট) আসামিদের চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান। এরপর জেলে থাকতেই একটি চক্রের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। এরপর সেই চক্রের সহযোগিতায় ১৭ লাখ টাকার চুক্তিতে হাইকোর্টের ভুয়া জামিন আদেশ তৈরি করে তাদেরকে জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়।
কিন্তু ঘটনাটি নজরে এলে হাইকোর্টের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি ‘উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন’ অনুসন্ধান কমিটি। যে কমিটির অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে আসে দালাল চক্রের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ও দায়িত্বে অবহেলার মতো ভয়াবহ সব তথ্য।
যেভাবে জালিয়াতি করা হয়
সুপ্রিম কোর্টের ‘উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন’ অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জাল জামিন আদেশ তৈরির প্রথম ধাপ শুরু হয় কোর্টের ফৌজদারি মিস. (বিবিধ) শাখায় কর্মরত এমএলএসএস (মূলত জমাদার) মঞ্জু রাণী কৈরীর সঙ্গে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সূত্র ধরে।
কমিটিকে দেওয়া জবানবন্দিতে মঞ্জু রাণী কৈরী স্বীকার করেন, ‘গত ১০ এপ্রিল আমাকে মিস শাখার ভেতরে একটি ছেলে একটি কাগজের কপি আমাকে দিয়ে বলে কাজ করে দিন। কাগজে ইংরেজি লেখা ছিল। আমি ইংরেজি পড়তে পারি না। কী লেখা ছিল বলতে পারি না। কাগজটি আমি টাইপিস্ট মনিরকে দেই এন্ট্রি করে দেওয়ার জন্য। বাইরের ছেলেটা কাজ করে দেওয়ার জন্য আমাকে ৩০০ টাকা দেয়।’
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জনৈক ব্যক্তির কাছে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জাল-জালিয়াতিপূর্ণ কাগজাদি গ্রহণ করে ফৌজদারি মিস. মোকদ্দমা ১৭১৫৭/১৮ সংক্রান্ত জালিয়াতিপূর্ণ জামিনাদেশ প্রস্তুতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং নিজ দায়িত্বের বাইরে আ. বাসেদের টেবিলে রক্ষিত রেজিস্ট্রার খাতায় এন্ট্রি দেয় মঞ্জু রাণী কৈরী। এখতিয়ারের বাইরে জানা সত্ত্বেও মঞ্জুর রাণীর অনুরোধে শাখার মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারী মো. মনিরুজ্জামান মনি, ড্রাফট এবং কম্পেয়ার করার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা মৌসুমী দেব এবং জামিন আদেশ টাইপ করার জন্য মুদ্রাক্ষরিক মো. মজিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর মৌসুমী দেব ওই জাল জামিন আদেশের ইস্যু কপি কম্পেয়ার শেষে তাতে স্বাক্ষর প্রদান করেন এবং শাখার সুপারিনটেনডেন্ট রশরঞ্জন মণ্ডলের নিকট পাঠান। রশরঞ্জন আদেশটি রেজিস্ট্রার খাতায় অন্তর্ভুক্ত না করে স্বাক্ষর দিয়ে হাইকোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম সুলতানার কাছে প্রেরণ করেন। এরপর সেখান থেকে আদেশটি র্যাকে রাখার জন্য আ. বাসেদের টেবিলে গেলে তিনি নিজ হাতে এন্ট্রি না দিয়ে মঞ্জু রাণীকে দিয়ে এন্ট্রি দেন। এরপর সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম সুলতানার স্বাক্ষর শেষে জামিনাদেশ ইস্যু করে কপি স্বাক্ষর শেষে পিয়ন বুকে এন্ট্রি দিয়ে তা আইটি শাখায় পাঠানো হয়। এরপর জামিনের ইস্যু কপি অনলাইনে আপলোডের পর ডেসপাস শাখার মাধ্যমে জামিন আদেশ জারি করা হয়। ‘
এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে জালিয়াতির প্রায় ৪০টির বেশি ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ পথ সবার জন্য উন্মুক্ত। এর ফলে বহিরাগত একটি চক্রের দৌরাত্ম্য এখানে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দিল্লি হাইকোর্টের প্রবেশ করতে হলে পাস নিয়ে যেতে হয়। সেখানে থাকা বুথ থেকে মামলার নম্বর, আইনজীবীর নাম বলে পাস নিয়েই তবে প্রবেশের অনুমতি মেলে। অথচ আমাদের সুপ্রিম কোর্টে অবাধে যে কেউ প্রবেশ করে এসব দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বিচার বিভাগের সুনাম নষ্ট করছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ ধরনের ঘটনা খুবই অপ্রত্যাশিত।’
জালিয়াতি ধরা পড়লো যেভাবে
চলতি বছরের ৮ এপ্রিল হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চ থেকে বিচারপতিদের নাম ও স্বাক্ষরসহ একটি জাল জামিন আদেশ বিচারিক আদালতে পৌঁছে। এরপর চট্টগ্রামের আদালতের আইনজীবীরা বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটকের পরও আসামিদের জামিন পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে অবহিত করেন। এরপর বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের নজরে আনা হলে জামিন আদেশটি জাল বলে প্রতীয়মান হয় এবং এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজতে রেজিস্ট্রার জেনারেল কর্তৃক একটি অনুসন্ধান কমিটি করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের অভিযুক্ত ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলেন
ফৌজদারি বিবিধ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার বেগম সুলতানা, ওই শাখার সুপারিনটেনডেন্ট (তত্ত্বাবধায়ক) মো. মুজিবুর রহমান, রশরঞ্জন মণ্ডল ও মো. জামাল উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আ. বাসেদ ও মৌসুমী দেব, মুদ্রাক্ষরিক তথা অফিস সহকারী মো. মজিবুর রহমান ও মো. মনিরুজ্জামান মনি এবং এমএলএসএস মঞ্জু রাণী কৈরী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, কিছু কিছু মামলার বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টে বেঞ্চ গঠন করা প্রয়োজন। অনেক মামলাই আদালত শুনতে চান না। সেক্ষেত্রে বিচার প্রার্থীরা বিকল্প পথ ধরে অসাধু চক্রের হাতে পড়েন। তাই প্রত্যেকটি আদালতের উচিত হবে বিচার প্রার্থীদের আর্জি শুনে তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে এ ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত হলেও আমরা তা রোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা একটি অনুসন্ধান শেষ করে আদালতে দাখিল করেছি। আদালতের আদেশ অনুসারে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। বাংলাট্রিবিউন