দুই বছর আগে যশোরের মাত্র ১০ বছরের মাহিম মোল্লা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া মা রুমা খানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বনগাঁয় অটোরিকশায় উঠতে গিয়েই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।
বৈধ-পাসপোর্ট নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে বেড়াতে এসে ভিসা শেষ হওয়ার পরও তিনমাস থেকে দালাল ধরে বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করছিলো নিতুন বিশ্বাস। কিন্তু শিয়ালদাহ স্টেশনে সে ধরা পড়ে যায় পুলিশের হাতে।
বাগেরহাটের মামুন, নড়াইলেরর হৃদয়, খুলনার মাহিমরা এসেছিল বিভিন্ন সময় কৌতূহলী চোখে ভারত দেখতে। তবে, সীমান্ত অতিক্রম করার পরই অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক হয় সেই কিশোরেরা।
এই শিশু-কিশোরদের ঠিকানা এখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বারাসাতের কিশলয় সংশোধনাগারে। সেখানে এই মুহূর্তে রয়েছে ২৮ জন বাংলাদেশি শিশু-কিশোর।
শুধু এই কিশলয়েই নয়, উত্তর দিনাজপুরের শুভায়ন, হাওড়ার লিলুয়া, কলকাতার দ্রুবাশ্রমসহ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অধীনে ২৭টি সংশোধনাগারে এই মুহূর্তে আটক বাংলাদেশি শিশু-কিশোরের সংখ্যাটা দুইশ অতিক্রম করেছে।
আটক এই শিশুদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার প্রক্রিয়াটি বরাবরই জটিলতর হওয়ায় সীমান্ত অতিক্রম করা এই শিশুদের পশ্চিমবঙ্গে হোমে থাকতে হয় বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে হোম কর্তৃপক্ষ নানাভাবে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের বাবা-মায়ের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করানোর ব্যবস্থা করে থাকে। আবার অনেক সময় ভারতীয় সেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোও তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এই ধরণের মানবিক সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসে। কিন্তু, তারপরও দুই দেশের প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে থাকতে হয় বাংলাদেশি শিশু-কিশোরদের।
দেরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, একজন বাংলাদেশি কিশোরকে আটক করার পর প্রথমে স্থানীয় পুলিশ কিংবা রেল পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে চালান কেটে তোলা হয় আদালতে। আদালতের নির্দেশনা পেয়ে পাঠানো হয় সংশোধনাগারে।
সংশোধনাগারে যাওয়ার পর সেখানে শুরু হয় কাউন্সিলিং, চিকিৎসা এবং পড়াশোনার মতো কার্যক্রম। এর ফাঁকে ওই আবাসিকের ঠিকানা সংগ্রহ করার চেষ্টা চলে। যদি ওই শিশু ঠিক মতো ঠিকানা বলতে পারে তবে সেই ঠিকানার তালিকা পাঠানো হয় রাজ্যের শিশু সুরক্ষা দফতরে। সেই দফতর আবার তা রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে পাঠায়। সেখান থেকেই তালিকাটি যায় কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরের কাছে। সেই তালিকা প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে তা ভেরিফাই করতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠায়।
ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আবার বিষয়টি খতিয়ে দেখে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স্থানীয় থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের পাঠায়। তারাই পশ্চিমবঙ্গে আটক বাংলাদেশি শিশুদের বাড়ি পৌঁছে তাদের ঠিকানা নিশ্চিত করে। নিশ্চিতকরণ হয়ে গেলে তারা আবার তাদেরই সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠায় রিপোর্টটি। সেই রিপোর্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের চ্যানেলে পৌঁছায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস কলকাতার দফতরে। এবার সেই কাউন্সিলর আটক বাংলাদেশি শিশু বা কিশোরের নাগরিকত্ব চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হন এবং ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করেন। সেই ট্রাভেল পারমিট পাওয়ার পর দুই দেশের সংশ্লিষ্ট বিজিবি-বিএসএফ তারিখ চূড়ান্ত করে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেয়। গোটা প্রক্রিয়াটি যুদ্ধকালীনভাবে হলেও ছয় মাস সময় লেগে যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তবে এবার বিষয়টিকে কিছুটা সরলীকরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আটক শিশুদের ফেরাতে বিশেষভাবে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস একটি জরুরি ব্যবস্থাও হাতে নিয়েছে। সেই ব্যবস্থা হচ্ছে, বিভিন্ন সূত্র মারফত কারো আটক হওয়ার তথ্য পাওয়ার পর উপ-দূতাবাসের কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট সংশোধনাগারে পৌঁছে যাবেন এবং তারাই সেখানে বাংলাদেশি শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কথা বললেন। সম্ভব হলে টেলিফোনে কথা বলবেন তাদের বাংলাদেশের পরিবার-পরিজনের সঙ্গেও।
গত ২৫ জুলাই সেই কার্যক্রম শুরু করেছে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে উপ-দূতাবাসের কাউন্সিলর ও হেড অফ চ্যান্সারি বি এম জামাল হোসেন জানান, “বারাসাতের কিশলয় হোমে এই মুহূর্তে ২৮ বাংলাদেশি শিশু-কিশোর আটক রয়েছে। আমরা তাদের সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এমনকি, কয়েকজন শিশুর পরিবারের সঙ্গেও। আশা করছি, আটক এই শিশুদের এক মাসের মধ্যে দেশে তাদের বাবা-মায়ের কোলে তুলে দিতে পারবো।”
“কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত ২৭টি এমন সংশোধনাগারে দুই শতাধিক বাংলাদেশি শিশু-কিশোর আটক রয়েছে। এক-এক করে আমরা বাকি হোমগুলো পরিদর্শন করে, আটক বাংলাদেশি শিশু-কিশোরদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদেরকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা শুরু করেছি,” যোগ করলেন বি এম জামাল হোসেন।
বারাসাতের কিশলয় হোমের সুপার মলয় চ্যাটার্জি বাংলাদেশি আটক শিশুদের নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, “দেখুন, প্রত্যেকটা শিশুর আটকের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা রয়েছে। কেউ বাবা-মাকে না বলে বেড়াতে এসে ধরা পড়েছে, কেউ দালালের মোটা মাইনের চাকরি-কাজ পাইয়ের দেওয়ার টোপ গিলে এখানে এসে ধরা পড়ে এই হোমে আটক রয়েছে। কেউ আবার পরিবার-পরিজনসহ সীমান্ত টপকে ধরা পড়ে এখানে- তবে সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে এই ঘটনাগুলো আরও বেশি করে প্রচার-প্রচারণায় আনতে হবে। টেলিভিশন-পত্রপত্রিকায় এসব ঘটনাকে তুলে ধরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নইলে রোজই এসব হোমে বাড়বে এই ধরনের মানবিক সংকটের ঘটনা।” সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার