পুরান ঢাকার নিম্ন আদালতে কার্টিজ পেপারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে রেজিস্ট্রিসহ বিভিন্ন দাফতরিক কাজে সেবা গ্রহীতাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। লিগ্যাল সাইজের এ পেপার কয়েক বছর আগেও বিক্রি হতো ৮ থেকে ১০ টাকা।
সংকটের কারণে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। গত চার বছর ধরে কার্টিজ পেপার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র স্বল্প মূল্যের কার্টিজ পেপার চড়া মূল্যে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
কার্টিজ পেপার সংকট ও চড়া মূল্যে একদিকে যেমন আইনজীবীরা বিপাকে পড়ছেন। অপরদিকে এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ সংকট নিরসনে শিগগিরই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেজিস্ট্রি অফিসের সব ধরনের দলিল, কোর্টে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের, সব দলিলের স্ট্যাম্প ছাড়া অতিরিক্ত সিটসহ অন্যান্য মামলা ও দলিলে এই কার্টিজ পেপার ব্যবহার করা হয়। আদালতপাড়া ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ ভেণ্ডারদের কাছে কার্টিজ পেপার নেই।
যাদের কাছে মজুদ আছে তারা চড়া মূল্য ছাড়া বিক্রি করছেন না। ক্রেতা সেজে স্ট্যাম্প ভেণ্ডার মো. জমিস উদ্দিনের কাছে কার্টিজ পেপার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে নেই বলে জানান। এরপর তিনি দিতে সম্মত হলেও এক পিসের দাম হাঁকেন ৫০ টাকা। পরে তিনি জানান, ৪৫ টাকার নিচে বিক্রি করবেন না।
দীর্ঘদিন সরবরাহ না থাকায় ভেণ্ডারদের দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখা যায় কার্টিজ পেপারের জন্য এক ভেণ্ডার অপর ভেণ্ডারদের কাছে ছোটাছুটি করছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবু বকর ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে কার্টিজ পেপার ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠেছে। সচরাচর ভেণ্ডারদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি পাওয়া যায়, তাতে চড়ামূল্য গুনতে হচ্ছে আইনজীবীদের।
৫-৭ টাকার কার্টিজ পেপার কিনতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। নির্ধারিত মূল্যের আট থেকে ১০ গুণ মূল্য বেশি না দিলে মিলছে না কার্টিজ পেপার। এতে একদিকে যেমন বাধ্য হয়ে আইনজীবীদের অতিরিক্ত মূল্যে কার্টিজ পেপার কিনতে হচ্ছে, অপরদিকে সরকার এ খাত থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
এ সংকট নিরসনে শিগগিরই সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
জানতে চাইলে ঢাকা সদর দলিল লেখক ও স্ট্যাম্প ভেণ্ডার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএস হোসেন টমাস বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কার্টিজ পেপার সরবরাহ না থাকার জন্য ট্রেজারি অফিস ও সরকারের (বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস) গাফিলতি রয়েছে। বিগত দুই বছর ধরে কার্টিজ পেপার সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে।
পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে থেকে সংগ্রহ করে হয়তো কেউ কেউ কার্টিজ পেপার বিক্রি করছে। আর এখন জেলাগুলোতে কার্টিজ পেপার নেই।’ তিনি বলেন, ‘কার্টিজ পেপার সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়।
১ রিম কার্টিজ পেপারের জন্য ২ হাজার ৪৫০ টাকা জমা দিতে হয়। নিয়ম অনুসারে এক পিস কার্টিজ পেপার ৬ থেকে ৭ টাকায় বিক্রি করার কথা।’
এদিকে কার্টিজ পেপার নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ট্রেজারি অফিসার ও সহকারী কমিশনার নাছরীন আক্তার। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ট্রেজারি শাখা সূত্র জানায়, চার বছরের অধিক সময় ধরে কার্টিজ পেপার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
প্রায় সাড়ে ৭০০ স্ট্যাম্প ভেণ্ডারদের চাহিদা অনুসারে বর্তমানে ন্যূনতম ৫ হাজার রিম (৪৮০ পিস কার্টিজ পেপারে ১ রিম) কার্টিজ পেপার প্রয়োজন। বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস থেকে দীর্ঘদিন ধরে কার্টিজ পেপার সরবরাহ করা হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর স্টেশনারি অফিস থেকে ৫ হাজার রিম কার্টিজ পেপার সরবরাহ করা হয়।
এরপর সরকারি কাজের জন্য এ পেপার জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হলে ঢাকা জেলা জজ ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ৫ হাজার রিমের চাহিদার বিপরীতে ৫০ রিম ট্রেজারি শাখায় সরবরাহ করে স্টেশনারি অফিস। চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল এ পেপার ট্রেজারি শাখায় আসে। সেখান থেকে চাহিদা মোতাবেক সরকারি কাজে আদালতসমূহে সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ২৯ রিম কার্টিজ পেপার এখনও ট্রেজারি শাখায় মজুদ রয়েছে।
তবে মজুদ থাকা পেপারগুলোও স্ট্যাম্প ভেণ্ডারদের মাঝে দেয়া হবে না। কারণ সেগুলোও সংরক্ষণ করা হচ্ছে সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য। এছাড়া কার্টিজ পেপার বিক্রির ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করা আছে। স্ট্যাম্প ভেণ্ডারা কোনোভাবেই এক পিস কার্টিজ পেপার ৫ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের ম্যানেজার মো. আবদুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছর আমরা কার্টিজ পেপার সরবরাহ করতে পারিনি। কারণ এ পেপার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর বিদেশ থেকে আমদানি সংক্রান্ত বিষয়ে ঠিকাদারদের দায়ের করা মামলা চলমান ছিল। সম্প্রতি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন পেপার আমদানি শুরু হয়েছে। চীন থেকে আনা হচ্ছে এ কার্টিজ পেপার। ইতিমধ্যেই কার্টিজ পেপার চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী দু’এক মাসের মধ্যেই ট্রেজারি অফিসগুলোতে আমরা কার্টিজ পেপার সরবরাহ করতে পারব। যুগান্তর