ভালোবেসে কিংবা পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। সুখের সংসার কাটানোর মধ্য দিয়ে ঘরে আসে নতুন অতিথি। কিছু দিন যেতে না যেতেই ওই সুখের সংসারে নেমে আসে অমিল কিংবা অশান্তি। আর তখনই কেউ কেউ হাটেন বিচ্ছেদের পথে। আবার কেউ বা থাকেন আলাদা।
কিন্তু এ বিচ্ছেদ বা আলাদা থাকাই শেষ কথা নয়। সংসারের নতুন অতিথি (সন্তান) বিচ্ছেদের পর কার কাছে থাকবে তা নিয়ে শুরু হয় টানাটানি। আর এ টানাটানি গড়াচ্ছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত।
কিন্তু এর শেষ কোথায়? এমন প্রশ্নে এসব মামলার লড়া আইনজীবীরা বলছেন, শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্যার ফলপ্রসু সমাধান হওয়া উচিত। এছাড়াও সমস্যা সমাধানে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। এমনকি আদালতও বলছেন, ভাঙা সংসারে শিশুর শারীরিক বিকাশ ঘটলেও মানসিক বিকাশ ঘটে না।
ঘটনা-১
পারিবারিকভাবে ২০১৫ সালে তাসমিয়া ও এহসানের বিয়ে হয়। পরে এ দম্পতির সন্তান ইয়াসিনের জন্ম হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হলে তাসমিয়া ইয়াসিনকে নিয়ে গুলশানে তার বাবার বাড়িতে চলে যান।
২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ছেলে নিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য তাসমিয়া গুলশানের একটি হাসপাতালে গেলে এহসান ও ইয়াসিনের দাদি ওই হাসপাতালে আসেন। কৌশলে এহসান তার ছেলেকে নিয়ে নিজেদের বাসায় চলে যান।
দুধের শিশু ইয়াসিনকে পাওয়ার আশায় তাসমিয়া গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করে মহিলা পরিষদের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কোনো কিনারা করতে না পেরে তাসমিয়া গত বছরের ২২ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করেন।
ঘটনা-২
ফরিদা ইয়াসমিন মনি। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানের নাম মৌসুম গাইন নীল। তার বাবা নিউটন গাইন ওরফে লিটন হোসেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বিয়ের পর সে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু তার পরিবার আমাদের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। বাচ্চা হওয়ার পর প্রায়ই ওর বাবা নীলকে দাদির বাড়ি নিয়ে যেত। একপর্যায়ে নেওয়ার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও সন্তানকে আর ফেরত দেয়নি। এমনকি স্বামীও আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। এ ঘটনার সুরাহা করতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে দারস্থ হয়ে কোনো প্রতিকার পাইনি। পরে আমি হাইকোর্ট রিট করেছি।’
ঘটনা-৩
২০০৮ সালের ২৭ জুন নওগাঁর সদর উপজেলার বাংগাবাড়িয়া গ্রামের মো. সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে একই উপজেলার কুসুমদি গ্রামের তৌহিদা আক্তারের বিবাহ হয়। পরে জন্ম নেয় ছেলে সাজফা সাজিদা। দাম্পত্য কলহের কারণে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সন্তানকে নিজ হেফাজতে নিতে হাইকোর্টে রিট করেন সাজ্জাদুর।
ঘটনা-৪
২০০২ সালে রাজশাহীর মেয়ে কামরুন্নাহার মল্লিকা এবং মাগুরার ছেলে মেহেদী হাসান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মল্লিকা পেশায় একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। আর মেহেদী বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। এরপর দাম্পত্য জীবনে দুই ছেলের বাবা হন মেহেদী হাসান। কিন্তু একপর্যায়ে এসে দুই জনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। এ মনোমালিন্য শেষ হয় ডিভোর্সের মাধ্যমে। ২০১৭ সালের ১২ মে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদের এক সপ্তাহ আগে দু’টি সন্তানকে গ্রামের বাড়ি মাগুরাতে পাঠিয়ে দেন মেহেদী। বড় ছেলের বয়স ১২ এবং ছোট ছেলের বয়স ৯ বছর। বোনের তত্ত্বাবধানের মাগুরার জেলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই সন্তানের দেখা পাননি মা মল্লিকা। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজের হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন মল্লিকা।
আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল গণমাধ্যমকে বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের সমস্যার কারণে এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। ঐতিহ্যগতভাবে এ ধরণের সমস্যাগুলো সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সমাধান করা হতো। কিন্তু এখন এটা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। হয়তো সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন উচ্চ আদালতে আসলে বিষয়টি তাদের জন্য ভালো হবে।
তিনি বলেন, আদালতের মাধ্যমে ২/১টি ঘটনার সমাধান হতে পারে। তবে এটি দীর্ঘ মেয়াদী ভালো ফল হবে না। এটির অবসনারে জন্য সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হবে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের ওপর আস্থা বিশ্বাস রাখতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।