প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘মিথ্যা মামলায় কেউ যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রকৃত আসামি কিংবা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় কিংবা বৃদ্ধ পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজনকে মামলায় জড়িত করার প্রবণতা আমাদের পরিহার করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় সোমবার (৩০ জুলাই) বিকেলে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিবিষয়ক’ শীর্ষক এ সভার আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, এ বছরের মার্চের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে বিচারাধীন নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮২টি। ২০১৭ সালে দায়ের হয়েছে ৫০ হাজার ৩৩২টি মামলা এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৯ হাজার ৬৬৪টি মামলা।
নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা প্রসঙ্গে সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘৪১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। ফলে আরও অধিক হারে মামলা নিষ্পত্তি হবে বলে আমি আশাবাদী। তবে শুধু মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তি নয়, মামলার গুণাগুণের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি প্রয়োজন। সে জন্য দরকার সঠিক তদন্ত, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, উদ্ঘাটন, সঠিক ডাক্তারি পরীক্ষা এবং মামলার সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতামূলক মনোভাব।’
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘এরই সঙ্গে মিথ্যা মামলায় যেন অযথা হয়রানি না হয়, সেদিকটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। প্রকৃত আসামি নয় এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এবং বৃদ্ধ পিতামাতা, ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজনকে মামলায় জড়িত করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন প্রণয়নে মহিলা পরিষদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিবাহবিচ্ছেদ, যৌতুক বহুবিবাহ, মোহরানা প্রদান ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে তারা কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য ও অগ্রগতি ইতিবাচক। তারপরও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। নির্যাতিতদের কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে পারিবারিক ও সমাজের প্রভাবের কারণে আইনের আশ্রয় থেকে বিরত থাকছে।
সভায় বিশেষ অতিথি সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, সংবিধানে নারীর অধিকার রক্ষার জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সামাজিক বাস্তবতায় নারীর অধিকার নিশ্চিত হতে পারে নারীর ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই নারীর ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে সাক্ষী উপস্থাপন না করতে পারা, সময়মতো মামলা শেষ করতে না পারাসহ আরও কিছু জটিলতা। সাত থেকে আট বছর হয়ে যায় অথচ একটি ধর্ষণ মামলার নিষ্পত্তি হয় না। নারী ও শিশু নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় স্বাস্থ্য, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে সমন্বিত মনিটরিং টিম করার ওপর জোর দেন তিনি।
সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সাধারণ মামলার বিচারের সঙ্গে একই ফর্মুলায় ধর্ষণের বিচার করলে সত্যিকারের বিচার কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। ধর্ষণের বিষয়টা অন্যরকম, স্পর্শকাতর। ইদানীং কতগুলো সহিংসতা বাড়ছে। আগে ধর্ষণ হতো কিন্তু ধর্ষণের পরও ধর্ষণের শিকার নারী বেঁচে থাকতেন। কিন্তু এখন ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। কারণ যাতে চিনতে না পারে, বলতে না পারে।’
ধর্ষণের ঘটনার পর দ্রুত বিচারের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণের মামলাগুলো বিচার অন্য মামলার বিচারের সঙ্গে হয় বলে দেরি হয়। কিছু ধর্ষণের মামলাকে নজরদারি করে দ্রুত বিচার করা উচিত। তাতে করে দ্রুত সমাধান হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘ভেজালবিরোধী ম্যাজিস্ট্রেটরা গিয়ে জেল দিয়ে দেন। অন্যান্য কিছু অপরাধ আছে স্পট অনুসন্ধান, স্পট সাজা। ধর্ষণের শিকার নারীদের ব্যাপারেও এগুলোর মতো করা যায় কিনা, সেটা ভেবে দেখা দরকার। ভিক্টিম নিজে সঙ্গে সঙ্গে যাতে বিচারের জায়গায় যেতে পারেন এবং রাত হোক, দিন হোক একজন বিচারক নির্ধারণ করা থাকবেন, ধর্ষণের শিকার কোনও নারী যদি আসে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডাক্তার ডেকে পরীক্ষা করাবেন। তৎক্ষণাৎ সাক্ষী নেবেন, আসামি ধরা থাকলে তাকে বলা হবে উকিল নিয়োগ করো, তাকে জেরা করো। পলাতক থাকলে পরবর্তীতে তাকে কীভাবে জেরা করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে ভাবতে হবে।’ এ জন্য সমাজবিজ্ঞানী, আইনবিদ ও বিচারকসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াস হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমার মতে নারীর নির্যাতনের আসল কারণ স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাব। দরিদ্রদের মধ্যে ঝগড়া হয় আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে। অনেক সময় যৌতুকের জন্য নারীকে নির্যাতন করা হয়। আর বিত্তশালী পরিবারগুলোতে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কারণে। এর সমাধান হিসেবে বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়েকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ ও পরামর্শ দেওয়া উচিত।’
শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের সমাজ এখন দুভাগে বিভক্ত। আমরা যারা স্বাভাবিক শিক্ষায় শিক্ষিত তারা এক রকম, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের চিন্তাধারা একরকম। আবার যারা মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত তাদের মূল্যবোধ আরেক রকম। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলে আমাদের দেশে সেটি নেই। এটা একটা চিন্তার বিষয়।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানমের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের সাধারণ সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক মো. জাফরোল হাছান প্রমুখ বক্তব্য দেন।