বহুল আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের ১১ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ (বৃহস্পতিবার)। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের রায় পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাই মাসদার হোসেন মামলার রায়টি বাস্তবায়ন করতে হলে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপন প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীরা।
আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘যদিও সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিচারাঙ্গণে অনেক দফতর স্থাপিত হয়েছে এবং কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও একটি সচিবালয়ের বাস্তবতা এখন সময়ের দাবি।’
প্রসঙ্গত, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি মো. হাসান আমিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৯৯৭ সালের ৭ মে মাসদার হোসেন মামলার রায় দেন। একই বছর আগস্টে সরকার হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে লিভু টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে।
এরপর ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে বিচারপতি লতিফুর রহমান, বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী ও বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার জন্য ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার আদেশ জারি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জানান, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হলেও গত কয়েক বছরে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়েছে। এর কারণ বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার মধ্য দিয়ে যে গেজেট নোটিফিকেশন (বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি) হওয়ার কথা ছিল, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বিদায় করে দিয়ে তারা সেটিকে (বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট) নিজেদের মতো করে নিয়েছে। কাজেই এখন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এদিকে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন হতে পেরেছে-এই প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ এখন কার্যত সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার বিভাগের আর্থিক এখতিয়ার, বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, পদায়নসহ সব কিছুই এখন সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যাস্ত।’
সচিবালয় এক প্রকারে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে চলে এসেছে বলেও মনে করেন শ ম রেজাউল করিম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় বিচার বিভাগের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নয় আর এখন। তারপরও বিভিন্ন রকমের অবকাঠামো, জনবল ও স্থাপনা বৃদ্ধি করা হলে ছোট ছোট সমস্যাগুলোরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। এ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও সরকারের নির্বাহী বিভাগের মধ্যে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনা ও কর্মসূচির ভিত্তিতে সম্পাদন করা সম্ভব।’
বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় কতটা যৌক্তিক- এই প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এটা অবশ্যই যৌক্তিক। আমরা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে বহুবার এ দাবি জানিয়ে এসেছি। বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরণের সচিবালয় রয়েছে। কারণ বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় না হলে, এই বিচার নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভর করলে, বিচারকদের দায়িত্ব পালন ব্যাহত হয়। আমরা সবসময়ই এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম উপাদান সচিবালয়। সেটা না হলে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকে না।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রয়োজন হলে বিচার বিভাগের জন্য অবশ্যই আলাদা সচিবালয় করা হবে। যারা বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা যদি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয়ের প্রয়োজন মনে করেন, তবে অবশ্যই সরকার সেটা করবে। আমাদের ব্যাপারে কোনও আপত্তি নেই।’
পৃথক সচিবালয়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. জাকির হোসেন বলেন, ‘সংবিধানে গাইড-লাইনগুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। বিচার বিভাগ কীভাবে চলবে বা কাজ করবে তা সংবিধানে বলা আছে। আমরা সে সংবিধান অনুসারেই চলছি।’ বাংলা ট্রিবিউন