নিম্ন আদালতে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির সাজার ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ না থাকলে সংসদ নির্বাচনে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অর্থাৎ সাজার ওপর স্থগিতাদেশ ছাড়া উচ্চ আদালতে আপিল চলমান থাকলেও কেউ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাদের গতকাল মঙ্গলবার (১৩ নভেম্বর) আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এই নির্দেশনা দেয় ইসি। একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংসদ নির্বাচন–সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দিতে গতকাল দিনভর রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি। নির্বাচনের সময় মন্ত্রীদের প্রটোকল কী হবে, উপজেলা চেয়ারম্যানরা পদে থেকে সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন কি না—এসব বিষয়ও উঠে আসে। তবে কিছু বিষয়ে তাঁরা ইসির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাননি। কিছু বিষয়ে ইসি পরে তাঁদের লিখিত নির্দেশনা দেবে বলে জানিয়েছে। ইসি সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক আসন্ন সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুটি মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন। একটি মামলায় আপিলের পর হাইকোর্টে তাঁর সাজা বেড়েছে। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে তাঁর সাজার ওপর স্থগিতাদেশ নেই। কিন্তু এরই মধ্যে তিনটি আসন থেকে তাঁর নামে দলীয় মনোনয়ন ফরম নেওয়া হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হলে ইসির গতকালের নির্দেশনা অনুসারে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হবে। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থিতা বাতিল করলে ইসির কাছে আপিল করার সুযোগ থাকবে। ইসিও যদি প্রার্থিতা বাতিল করে, তাহলে তিনি উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে কাল একাধিক কর্মকর্তা জানান, সভার শেষ পর্বে ছিল উন্মুক্ত আলোচনা। মূলত এই পর্বে রিটার্নিং কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিষয়ে ইসির কাছে জানতে চান। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচন–সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা, হলফনামা, মনোনয়নপত্র বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ, পর্যবেক্ষক নীতিমালাসহ বিভিন্ন বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ধারণা দেওয়া হয়।
এবার নির্বাচন হবে সংসদ বহাল রেখে, দলীয় সরকারের অধীনে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের ‘প্রটোকল’ কী হবে অর্থাৎ মন্ত্রীরা কী কী সুবিধা পাবেন—তা জানতে চান একজন কর্মকর্তা। জবাবে ইসি বলেছে, কোনো মন্ত্রী প্রার্থী হলে তিনি ‘প্রটোকল’ পাবেন না। তবে নিরাপত্তা পাবেন। আর নির্বাচন–সংক্রান্ত কাজ ছাড়া অন্যান্য সরকারি কাজে প্রটোকল পাবেন। প্রার্থী হওয়ার পর তাঁরা এলাকার সার্কিট হাউস ব্যবহার করে প্রচার চালাতে পারবেন না। এমনকি মন্ত্রিত্বের ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন না। তাঁরা সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা লাভজনক পদে থাকা কেউ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না, বা তাঁদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হবে কি না—জানতে চান কেউ কেউ। ইসি বলেছে, এ বিষয়ে শিগগির একটি নির্দেশনা জারি করা হবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জানানো হয়, ছোটখাটো ভুলে কারও মনোনয়নপত্র বাতিল করা যাবে না। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় সর্বোচ্চ পাঁচজন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঢুকতে পারবেন। নির্বাচন কাজের জন্য যুক্ত হয়ে কোনো নির্বাচনী কর্মকর্তা অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
নির্বাচন আর পেছানোর সুযোগ নেই
সভার শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, নির্বাচন আর পেছানোর সুযোগ নেই। ৩০ ডিসেম্বরও যথেষ্ট সময় নয়, অত্যন্ত ‘কমপ্যাক্ট টাইম’।
নির্বাচন আর পেছানোর সুযোগ না থাকার পেছনে যুক্তি দিয়ে সিইসি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এত বড় একটি নির্বাচনের পর ২৯ জানুয়ারিতেই সংসদ বসতে হবে। ৩০০ আসনের ফলাফলের গেজেট করার জন্য সময় লাগে। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমা হবে ১১ জানুয়ারি। এ সময় সারা দেশ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সেখানে আনতে হয়।
এবার নতুন প্রেক্ষাপটে ভোট হচ্ছে উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, এ বছর নির্বাচনের পরিবেশ হবে ভিন্ন। এর আগে দেশে কখনো রাষ্ট্রপতিশাসিত নির্বাচন, কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, কখনো সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, সংসদ রেখে, সরকার রেখে এই নির্বাচন হবে। ২০১৪ সালে এমন নির্বাচন হলেও তখন সব দল অংশ নেয়নি। এবার সব দল অংশ নিতে যাচ্ছে। যে কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্বও অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
সিইসি বলেন, নির্বাচনে ভোটের গোপন কক্ষ ছাড়া সবকিছুই হবে স্বচ্ছ। পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক, প্রার্থী, প্রার্থীর এজেন্টরা সবকিছু দেখতে পাবেন। নির্বাচন হবে অবাধ ও উৎসবমুখর।
অন্যদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
ইসি সূত্র জানায়, আজ থেকে শুরু হচ্ছে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান। আজ বুধবার ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ, কাল সিলেট, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ এবং পরদিন রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
ইভিএমের প্রশিক্ষণ সেনাবাহিনীকে
ইসি সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ইভিএম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে ইসি। সশস্ত্র বাহিনীর ৬৪ জন কর্মকর্তা এবং ২১০ জন জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) ও অন্যান্য পদবির সদস্যদের ইভিএম–বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে গতকাল চিঠি দিয়েছে ইসি। প্রথম আলো