ঘুরেফিরে মাসের পর মাস ১১ আসামির হাসপাতালবাস

ঘুরেফিরে মাসের পর মাস ১১ আসামির হাসপাতালবাস

রাজনৈতিক মামলার আসামিরা কারাগারে বন্দী থাকলেও অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার, মাদক এবং খুনের মামলার কয়েকজন আসামি ঘুরেফিরে মাসের পর মাস তাঁদের পছন্দের হাসপাতালে থাকছেন। তাঁদের হাসপাতালে থাকার মেয়াদ ২ থেকে টানা ৬ মাস হয়ে গেছে।

দেশের প্রায় ৯৩ হাজার কয়েদি-হাজতির মধ্যে সৌভাগ্যবান এই ব্যক্তিরা হলেন ৭৯ বছর সাজাপ্রাপ্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার মামলার আসামি ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, রূপালী ব্যাংকের ১৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং মামলায় আটক অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক, বরিশালের কলেজছাত্রী ফৌজিয়া আক্তার চাঁপা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া জহিরুল আলম। তাঁরা ঘুরেফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে ১৫৩ জন কয়েদি ও হাজতি হাসপাতালে আছেন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন আছেন দীর্ঘদিন ধরে। শুধু এবারই তাঁরা লম্বা সময় হাসপাতালে থাকছেন না, তাঁদের কয়েকজন বছরের পর বছর এই সুবিধা ভোগ করছেন।

৪ নভেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, সাখাওয়াত হোসেন টানা ৬ মাস ১৩ দিন হাসপাতালে আছেন। তিনি ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার হয়ে মাত্র ৫ দিন কারাগারে ছিলেন। বগুড়ার মোকামতলা বন্দরের দেউলী গ্রামে অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। দুদক তাঁর বিরুদ্ধে রূপালী ব্যাংকের ১৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেছে। তিনি টাটকা ফুড প্রোডাকশন ফ্যাক্টরিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক।

ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা ১৮ মাস হাসপাতালে কাটিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে কয়েক দফা খবর প্রকাশিত হয়। আগে তিনি বারডেম হাসপাতালে থাকলেও এবার উঠেছেন বিএসএমএমইউতে। আছেন ২ মাস ৫ দিন। এর আগে গত ৫ থেকে ২৯ মার্চ ২৪ দিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন। দুই মামলায় তাঁর ৭৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন ৬ মাস ১০ দিন হাসপাতালে আছেন। এর আগে ১৮ জানুয়ারি থেকে ১২ এপ্রিল মোট ২ মাস ২৪ দিন হাসপাতালে ছিলেন। এই হিসাবে, বছরের সাড়ে দশ মাসের মধ্যে নয় মাসের বেশি তিনি হাসপাতালে কাটিয়েছেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক ২ মাস ২১ দিন ধরে হাসপাতালে অবস্থান করছেন। এর আগে তিনি ৮ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত মোট ৬ মাস ২৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন। একই মামলায় দণ্ডিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিশেষ কারাগারে আছেন।

বরিশালের চাঁপা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জহিরুল আলম টানা ২ মাস হাসপাতালে অবস্থান করেছেন। এর আগে ১৪ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত তিনি ১৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন। আগেও কয়েক দফা ঘুরেফিরে হাসপাতালে কাটিয়েছেন। কারা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, ৩০ অক্টোবর তিনি কাশিমপুর কারাগারে ফিরে গেছেন।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নানা সমস্যা থাকায় তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে তাঁদের ফেরত পাঠাতেও চিঠি দিয়েছি।’

এ ছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ মাস ২৩ দিন ধরে আছেন কয়েদি মো. সিরাজুল এবং ২ মাস ১৮ দিন ধরে আছেন হাজতি মো. রফিকুল। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ৩ মাস ধরে থাকছেন হাজতি মিস্টার ও সাইদুল। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ মাস ধরে আছেন হাজতি আলতাফ মৃধা এবং প্রায় ৩ মাস ধরে আছেন মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত আসাদুল।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এত কড়াকড়ির পরও আবার কেন তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হলো, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। যদি কারাগারের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছে। দুই দফা তাগিদ দিয়েও কোনো তথ্য পায়নি মন্ত্রণালয়।

বিএসএমএমইউর পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এরা ভর্তি হলে আর যেতে চায় না। কেউ কেউ অপারেশন করে দীর্ঘ মেয়াদে থাকে।’ মেডিকেল বোর্ড গঠন করে কেন প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এই বেআইনি সুযোগ-সুবিধা থেকে স্পষ্ট, এঁরা অপরাধ জগতের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁরা কারাগারে যাচ্ছেন বা আছেন, তাঁদের চিকিৎসাসেবা পেতে অনেক ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ লাগছে। এসব বন্ধে কারাগারের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির অনুসন্ধান করা উচিত। পাশাপাশি কাদের সুপারিশে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা হাসপাতালে থাকছেন, তা-ও দেখা উচিত। প্রথম আলো