নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার ঠেকাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই কমিশনটির ইন্টেলিজেন্সি টিম বিশেষ নির্দেশনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
আজ বৃহস্পতিবার (৬ ডিসেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ তথ্য দেন।
এসময় দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের কোনো মানুষই চায় না বা আপনারা, আমরা কেউই চাই না যে নির্বাচনে কালো টাকা ব্যবহার হোক। এজন্য আমাদের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে একটা গাইডলাইন দিয়েছি। তবে এখন এটি আমি প্রকাশ করতে চাই না। সেক্ষেত্রে ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে বলছি- কে কতগুলো গরু জবাই করলেন, কীভাবে ইলেকশনের প্রচারণা শুরু হলো, কতগুলো গরু, কতগুলো খাসি জবাই করলেন, কতগুলো লাল পোস্টার বানালেন; যেটা আইনসিদ্ধ নয়। সেগুলো আমাদের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কালেক্ট করে একটি তালিকা তৈরি করবে। পরে আমরা ওই রিপোর্ট নিয়ে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেবো। এ বিষয়টি নিশ্চিত করবো।
তিনি বলেন, ফ্ল্যাট এবং প্লটেও কালো টাকা চলে যাচ্ছে। এ বিষয়টি দুদক অবহিত। দুদক সরকারের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ পাঠিয়েছে। সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে বলে দুদক প্রত্যাশা করে। তবে কালো টাকা যদি বিনিয়োগ হতো, তাহলে দেশের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারতো।
নির্বাচনে হলফনামা নিয়ে দুদকের ব্যবস্থা বিষয়ে জানতে চাইলে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সবকিছু সত্যই বলতে হবে। সত্য সত্যই। পৃথিবীর সব দেশেই জনগণের প্রত্যাশা থাকে নেতার চরিত্র পবিত্র হতে হবে। আমাদের দেশেরও নেতার নেতৃত্বে অবশ্যই সততা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এ জন্য নির্বাচনের আগেই বলেছিলাম যারা হলফনামায় তথ্য দেবেন, তা যেনো সঠিক হয়। হলফনামা পাবলিক ডকুমেন্ট। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিট প্রতিটি হলফনামা ডাউনলোড করছে। তবে কি করবো ভবিষ্যৎ বলবে। আমরা বই আকারে সংরক্ষণ করছি। সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধানশাসিত সংস্থায় জমা দেওয়া প্রার্থীদের স্টেটমেন্টও সংগ্রহ করা হচ্ছে। মিলিয়ে দেখেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, মাথায় পচন ধরলে শরীর বাঁচানো কঠিন বা সে চেষ্টা বৃথা। তাই রাজনৈতিক স্পষ্টতা, জবাবদিহিতা, কমিটমেন্ট, দূরদর্শিতা ও সততা না থাকলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কঠিন।
ঋণ খেলাপির প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, এ বিষয়টি আমাদের না, ব্যাংকের। তবে যদি কেউ জাল-জালিয়াতি করে ঋণ নেন, তাহলে বিষয়টি দুদকের। এজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি অডিট রিপোর্ট দিতে হবে। অনেকেই আছেন, তাদের কোম্পানিও আছে। যারা এনবিআরকে এক রকম ও ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম অডিট রিপোর্ট দেয়। আমরা এইসব জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছি।
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা দুর্নীতি নয়। এমনকি টিআইবিও যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা-ও দুর্নীতি নয়। আপনার বিবেক যাতে সাড়া দেয় না, বিবেকের বিরুদ্ধে যা করেন, তা-ই দুর্নীতি।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান জানান, কমিশন বিগত ১২ বছরে (২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৮৯টি মামলা দায়ের করেছে। একই সময়ে পাঁচ হাজার ৫২০টি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে (বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলের মামলাসহ)। বিগত ১০ বছরে (২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) এক হাজার ৩২১টি মামলায় আসামিদের বিচারিক আদালতে সাজা হয়েছে (বিলুপ্ত দুর্নীতি দমনব্যুরো আমলের মামলাসহ)। কমিশনের মামলা সাজার হার ২০১৭ সালে ছিল ৬৮ ভাগ। এ সাজার হার ক্রমাগত বাড়ছে। কমিশন কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি মামলা মনিটরিং করছে। মামলার বাদী, সাক্ষী এবং প্রসিকিউটরদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এছাড়া কমিশনের অনুসন্ধান/তদন্ত এবং প্রসিকিউসন কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কমিশনের প্রত্যাশা শতভাগ মামলায় সাজা দেওয়া। এক্ষেত্রে কমিশনের সক্ষমতার ঘাটতিকে আমরা অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণের পাশাপাশি একটি কারণ হিসেবে মনে করি। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশে ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করি না।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনে মানুষ প্রতিনিয়তই অভিযোগ জানাচ্ছে। শুধু গত বছরই কমিশন প্রায় ১৮ হাজার লিখিত অভিযোগ পেয়েছে। এ বছরেও নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ২২৭টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত কমিশনের অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন ১০৬-এ অভিযোগ জানাতে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ২২০টি ফোন কল এসেছে। এতে আমাদের মনে হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। মানুষ দুর্নীতি পরায়ণদের মন থেকে ঘৃণা করে। দুর্নীতি এমন অপরাধ যা খুব বেশিদিন লুকিয়েও রাখা যায় না। এ অপরাধ তামাদি হয় না। এটি প্রকাশ হবেই।
মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের মধ্যে অংশ নেন মাহফুজ আনাম, খায়রুল বাশার মুকুল, এমদাদুল হক মিলন, খ ম হারুন, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, আবদুল কাউয়ুম, মোজাম্মেল বাবু, জ ই মামুন, মুস্তাফিজ শফি, শামীমুল হক, রাহুল রাহা, আশিষ সৈকত ও মঞ্জুরুল হক প্রমুখ।