বেল্লাল হোসাইন :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় অর্জনের ইতিহাস নয় মাসের নয়। ভারত ভাগের পর থেকে পরবর্তী চব্বিশ বছরের ক্রমাগত বঞ্চনা ও শোষণের চরম পরিণতি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের গণসংগ্রাম। আমাদের মুক্তি আন্দোলনের চেতনা বীজ রোপিত হয় ভাষা বঞ্চনার পর থেকেই। এরপর ধারাবাহিকভাবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং জেল-জুলুম, হুলিয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশীরা যে বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী পরিকল্পনায় যুদ্ধ করে তাতে বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীনতাকামীদের চেয়ে দ্রুত বিজয় সূচিত হয়।
কিন্তু কোন বিষয়গুলো আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে এমন বেপরোয়াভাবে উৎসাহ দিলো? কেন তারা ধুকে ধুকে মরার চেয়ে আমাদের জন্য একটা স্বাধীন প্লাটফর্ম রেখে যেতে হাঁসিমুখে বুকে গ্রেনেড নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল? কেন সেই সময়ের জয়িতা মায়েরা তাদের সন্তানকে, সাহসী স্ত্রীরা তাদের স্বামীকে বলে দিল, যাও লড়াই করো?
আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এর খোঁজ নিতেই হবে। কারণ আমাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। যে ভূখণ্ডের মালিকানা আমরা দাবি করি, যে সার্বভৌমত্বের গৌরবে নিজেকে স্বাধীন ও অধিকার প্রয়োগের চর্চা করি তার ভিত্তিমূল খুঁজতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয় মুজিব নগর সরকারের দিকনির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। সেই সরকারের আইনি ভিত্তি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে।
এই ঘোষণার কিছু অংশ নিম্নরুপ,
“সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; “
সাধারণ মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওয়াদা ও আশ্বাস ব্যাপক ব্যঞ্জনাময় ছিল তাই তাঁরা শোষণের অবসান ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে আদুল গায়ে উর্দিওয়ালা হানাদারদের সামনে বুক উঁচু করে দাড়িয়ে ছিলেন।
বাংলাদেশের সংবিধান হলো মৌলিক আইন। সংবিধানের প্রস্তাবনা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত যা অসংশোধনীয় করা হয়েছে। সেই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে,
“……..আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে ;]
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে; “
এই কথাগুলোই মুক্তিযুদ্ধের আইনি ভিত্তি। মহান মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া ও সেই চাওয়ার সাংবিধানিক স্বীকৃতির চেয়ে বড় আইনি ভিত্তি কী হতে পারে?
আমাদের পূর্বসূরীরা উল্লেখিত প্রত্যাশার বাস্তবায়ন যাতে হয় সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
আমাদের কাজ হলো তাঁরা যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালু রাখা। এটাই মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা। এই বাইরে যে যা বলে তা চেতনার ব্যবসা বৈ অন্য কিছু না।
মনে রাখতে হবে সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। কাজেই সেই সময়ের আলোচনা ও পরিকল্পনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চক্ষুষ্মান তথ্য প্রমাণ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গৃহীত হয়। কালে কালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের অবিবেচনাপ্রসূত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ব্যবহার আজ সংবিধান ও চেতনা শব্দদ্বয়কে লোকের কাছে হাস্যকর প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
কিন্তু তারুণ্যের বৈশিষ্ট্যে অভিমান-অনুযোগ থাকতে পারে না। আমরা বীরদের উত্তরসূরী। তাদের অসমাপ্ত কাজ আমাদের করতেই হবে। সবাইকে সক্রিয় রাজনীতি করতে হবে এমন নয়। প্রত্যকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা বাস্তবায়নে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষানবিস আইনজীবী ও সমাজকর্মী। ই-মেইল : bellal.sincere@gmail.com